ইমদাদুল ইসলাম: টাঙ্গাইলের সদর উপজেলার সিলিমপুর ইউনিয়নে যৌতুকের দাবিতে এক গৃহবধূকে খুঁটিতে বেঁধে অমানবিক নির্যাতন করে তার স্বামী। দৈনিক পত্রিকায় গত ৩ জুন সংবাদটি প্রকাশিত হয়। পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী শ্বশুরবাড়ির সদস্যরাও নির্যাতনে অংশ নেন। নির্যাতিত মহিলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছেন। স্ত্রী নির্যাতনের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। বাংলাদেশে প্রতি দুজন নারীর মধ্যে একজন নির্যাতনের শিকার হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের অর্ধেকই জীবনে কখনও না কখনও স্বামীর হাতে শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
দেশে নারী নির্যাতনের উচ্চ হারের প্রধান কারণ মানসিকতা, পুরুষ সঙ্গী ছাড়া নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পরিবার ও সমাজকে দায়িত্ব নিতে হবে। কভিড মহামারিকালে নারী নির্যাতন বেশি হচ্ছে। কভিডকালে দেশে ২৩ শতাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর প্রধান কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কভিডকালে বাইরে ঘোরাঘুরি কমে গেছে, দীর্ঘ সময় ঘরে থাকায় আর্থিকসহ নানা দুশ্চিন্তার কারণে পুরুষরা সহিংস হয়ে উঠছেন। আর এর বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে নারী নির্যাতনের মাধ্যমে। নারী নির্যাতনের বিষয়ে মাত্র ৬ শতাংশ আইনের আশ্রয় নিয়ে থাকে, বাকিরা পারিবারিক সম্মানের কথা ভেবে চেপে যায়। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ক্ষমতার কাঠামো, শিক্ষাব্যবস্থা ও আইনি কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন মর্মে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সরকার নারী নির্যাতনের শিকার নারীদের সহায়তা করতে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং করছে। নির্যাতনের শিকার নারীদের জন্য জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯ চালু করেছে। প্রতিদিন আট হাজারেরও বেশি কল আসে এ হেল্পলাইনে সাহায্য চেয়ে। সরকারের ৫৪টিরও বেশি সেবা পাওয়া যায় এখন ফোনকলের মাধ্যমে। ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেলের মাধ্যমেও নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুরা সেবা নিচ্ছেন। করোনাকালে তথ্য প্রবাহে কিছুটা বিঘœ ঘটায় নারী নির্যাতনের সঠিক চিত্র পেতে সমস্যা হচ্ছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে নানারকম পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑনারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ও বিধি প্রণয়ন, নারী ও শিশু পাচার সংক্রান্ত তথ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রেরণ। নারী ও শিশু নির্যাতনের তথ্য ও অভিযোগ সংগ্রহ ও বিধিগত ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ, গণমাধ্যমে প্রকাশিত নারী ও শিশু নির্যাতন-সংক্রান্ত অভিযোগগুলো তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের অনুরোধ করা। ডিএনএ ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা ও আইনি সহায়তা দেয়া। এছাড়া জাতীয় মহিলা সংস্থার অধীনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সেল নামে একটি লিগ্যাল এইড সেল রয়েছে। সপ্তাহে দুদিন চার সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটির মাধ্যমে নির্যাতিত দুস্থ অসহায় মহিলা ও শিশুদের বিনা খরচায় আইনগত সহায়তা দেয়া হয়ে থাকে। এছাড়া জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দুস্থ অসহায় মহিলা ও শিশুদের আইনগত সহায়তা দেয়ার জন্য জাতীয় মহিলা সংস্থা মনোনীত দুজন আইনজীবী রয়েছেন। তারা বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দিয়ে থাকেন। ইউনিয়ন পর্যায়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী ও বেগবান করার জন্য মহিলা সহায়তা কর্মসূচি প্রকল্প নামে একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ৬টি বিভাগীয় শহরে নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে ৬টি সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে সব শ্রেণির নির্যাতিত মহিলাদের অভিযোগ গ্রহণ, উভয়পক্ষের বক্তব্য গ্রহণ ও পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপন, সন্তানের ভরণপোষণ, দেনমোহর ও খোরপোষ আদায়সহ সব ধরনের আইনগত সহায়তা করা হয়।
সেলে নিযুক্ত উপপরিচালক, আইনজীবী ও সমাজকল্যাণ কর্মকর্তারা এসব শুনানি ও পরামর্শ প্রদান করেন। অনিষ্পত্তিকৃত অভিযোগগুলো সেলের আইনজীবীর মাধ্যমে পারিবারিক ও ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বাদীর পক্ষে মামলা পরিচালনা করা হয়। মহিলা সহায়তা কেন্দ্রে নির্যাতিত দুস্থ, অসহায় ও আশ্রয়হীন মহিলাদের দুটি শিশুসন্তানসহ (অনধিক ১২ বছর) ৬ মাস আশ্রয় সুবিধা প্রদান, কেন্দ্রে বিনা খরচায় থাকা ও খাবার ব্যবস্থা, বস্ত্র, শিক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা প্রদানসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬৪ ভাগ নারী ও শিশু। তাদের জীবন সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঝুঁকিপূর্ণ। সামাজিক পরিস্থিতিসহ নানা কারণে বিচারের সময়ে মহিলা, শিশু ও কিশোরীদের নিরাপত্তার জন্য নিরাপদ আবাসন কেন্দ্রে থাকতে হয়। এই হেফাজতে থাকার সময়ও কখনও কখনও তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিজ্ঞ আদালতে বিচারাধীন মামলায় মহিলা, শিশু ও কিশোরী ভিকটিমরা মামলা চলাকালে যাতে জেলখানার বাইরে নিরাপদ আবাসন সুবিধাসহ তাৎক্ষণিক আইনগত সুবিধা পায় সেটা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০০১ সাল থেকে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের লালমাটিয়ার ভবনে ৪০-৪৫ জনের নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সাল থেকে লালমাটিয়াসহ নিরাপদ আবাসন কেন্দ্রটি গাজীপুরে স্থানান্তর করা হয়। তিন তলাবিশিষ্ট এ ডরমিটরিতে ১০০ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এ কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক ৭ সদস্যের পুলিশের একটি টিম নিয়োজিত আছে, এর মধ্যে দুজন মহিলা পুলিশ সদস্য রয়েছে।
এখানে মূলত কোর্ট থেকে প্রেরিত বিভিন্ন মামলার ভিকটিম-হেফাজতিরা (বাড়ি থেকে পালায়ন, হারানো, ধর্ষণ, হত্যা মামলার সাক্ষী ও অন্যান্য মামলা) এ কেন্দ্রে হেফাজতি হিসেবে অবস্থান করে। এখানে হেফাজতি মহিলা, শিশু ও কিশোরীরা বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা, বস্ত্র, শিক্ষা ও বিনোদনের সুবিধা পেয়ে থাকে। নির্ধারিত শুনানির দিন নিরাপত্তার সঙ্গে আদালতে হাজির করা এবং আদালত থেকে একইভাবে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়। আশ্রয়কালে মহিলা ও কিশোরীদের দক্ষ জনসম্পদে উন্নীত করার লক্ষ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়। প্রকৃতপক্ষে যারা নারী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত তারা এক ধরনের ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকে। নানা কৌশলের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়াকে দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে ফেলে দেয়। এতে করে এক সময় বিচারপ্রার্থী হতাশ হয়ে পড়ে এবং ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। সাক্ষী অনুপস্থিতি এবং মামলার জটের কারণে ও বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হয়। সরকার এ সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করছে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার দর্শন অনুসারে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের নতুন ধারা সূচিত করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত উদ্যোগের ফলে উচ্চশিক্ষাসহ সব ধরনের শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীদের শতভাগ অংশগ্রহণ, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উদ্যোক্তা তৈরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, সুরক্ষা ও নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। নারী ও শিশুর সকল ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে জাতীয় পর্যায়, বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন কঠোরভাবে দমন এবং প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদারকরণের লক্ষ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ধারা ৯-এর উপ-ধারা (১) অধীন ধর্ষণের অপরাধের জন্য ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শাস্তির পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড’ করা হয়েছে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে সামনে রেখে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন, উত্ত্যক্তকরণ, অবহেলা ও নিপীড়নের ঘটনাগুলো চিহ্নিত করে তা সুরাহায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো নিয়মিত, কার্যকরী এবং শক্তিশালী নিরীক্ষণের আওতায় আনা জরুরি। এ দায়িত্বে পরিবার ও সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করে দেশব্যাপী মানবতা উন্নয়নে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হলে একমাত্র উপায় হচ্ছে সুরক্ষায় সর্বজনীন আন্দোলন সৃষ্টি, যা এগিয়ে নেয়ার এখনই সময়।
পিআইডি নিবন্ধন