ইসমাইল আলী: গ্যাস না পাওয়া ও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকার প্রভাব পড়েছে দেশের বিদ্যুৎ খাতে। উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড লোকসানের সম্মুখীন হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এতে এক বছরে সংস্থাটির লোকসান বেড়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। এ ঘাটতি মেটাতে পিডিবিকে রেকর্ড পরিমাণ ভর্তুকিও দেয়া হয়েছে গত অর্থবছর। তবে ঘাটতির চেয়ে ভর্তুকি কিছুটা বেশি হওয়ায় ব্যালেন্স শিটে লোকসানের পরিবর্তে মুনাফা দেখাচ্ছে পিডিবি।
সংস্থাটির তথ্যমতে, গত অর্থবছরে পিডিবির লোকসান দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৫০৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। এর আগের (২০১৯-২০) অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ ছিল সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে পিডিবির লোকসান বেড়েছে চার হাজার ৬০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রেকর্ড লোকসান করেছিল পিডিবি। সে অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৩১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
যদিও লোকসানের ঘাটতি মেটানোর জন্য গত অর্থবছরে পিডিবিকে রেকর্ড পরিমাণ ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। এর পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৭৭৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা। আর তার আগের (২০১৯-২০) অর্থবছরে পিডিবিকে ভর্তুকি দেয়া হয় সাত হাজার ৪৩৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি বেড়েছে চার হাজার ৩৩৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বা ৫৮ দশমিক ৩১ শতাংশ।
তথ্যমতে, লোকসানের চেয়ে গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে প্রদত্ত ভর্তুকি কিছুটা বেশি ছিল। এতে ব্যালেন্স শিটে লোকসানের পরিবর্তে ২৬৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা মুনাফা দেখিয়েছে পিডিবি।
এদিকে গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে লোকসান অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির ব্যাখ্যা চায় অর্থ মন্ত্রণালয়। গত ৬ সেপ্টেম্বর পিডিবিকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এর জবাবে পিডিবি জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে ফার্নেস অয়েলের দাম বেড়ে প্রতি মেট্রিক টন ৫৩০-৫৫০ ডলার হয়েছে, যা ২০২০ সালে মে মাসে ছিল ৩৪০-৩৬০ ডলার। আর ২০২০ সালের জুনে ফার্নেস অয়েল আমদানিতে শুল্ক-কর অব্যাহতি প্রত্যাহার করায় এ খাতে ব্যয় ৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার পরিমাণ বছরে ৩৫০-৪০০ কোটি টাকা। যদিও জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম স্থিতিশীল থাকায় এ খাতে ব্যয় তেমন বাড়েনি। তবে নভেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ক্রমেই বাড়তে থাকে। এর প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ে।
পিডিবি আরও জানায়, গ্যাসভিত্তিক আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় ২০২০ সালের মে মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬৮ শতাংশ আর তরল জ্বালানিভিত্তিক ছিল ৩২ শতাংশ। তবে গ্যাস সরবরাহ হ্রাস পাওয়ায় চলতি বছর মে মাসে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদনের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৪৩ শতাংশ, তরল জ্বালানিভিত্তিক ৪৫ শতাংশ, কয়লাভিত্তিক ১১ শতাংশ ও সোলার এক শতাংশ। এতে গত বছরের মে মাসের তুলনায় চলতি বছর মে মাসে ঘাটতি বেড়েছে ৫৭ শতাংশ।
এদিকে বাংলাদেশ ও চীন যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত পায়রা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে এলেও সঞ্চালন লাইনের সীমাবদ্ধতায় পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কিন্তু ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হচ্ছে। এতে বছরে ঘাটতি হচ্ছে ১৭০-১৮০ কোটি টাকা। আর বিইআরসি কর্তৃক সর্বশেষ প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের বিক্রয়মূল্য পাঁচ টাকা ১৭ পয়সা নির্ধারণ করলেও বর্তমানে তা কমে পাঁচ টাকা ১১ পয়সা হয়েছে। সব মিলিয়ে ঘাটতি বেড়েছে।
লোকসান বৃদ্ধির কারণ প্রসঙ্গে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. বেলায়েত হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, গ্যাসের সরবরাহ কমায় তরল জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামও অনেক বেড়ে গেছে। আবার ফার্নেস অয়েল আমদানির শুল্ককর অব্যাহতি তুলে দেয়ায় এ ব্যয়ও বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। ফলে লোকসান বেড়ে গেছে।
উল্লেখ্য, ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত এক দশকে ৭৫ হাজার ১৪২ কোটি ৪২ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে পিডিবি। এর মধ্যে ২০১০-১১ অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসান ছিল চার হাজার ৬২০ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। পরের অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৬৯৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। তবে ২০১২-১৩ অর্থবছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৪৩ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
যদিও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে পিডিবি লোকসান বেড়ে হয় ছয় হাজার ৮০৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সাত হাজার ২৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা আবার কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ৮৭৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চার হাজার ৪৩৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পিডিবির লোকসান বেড়ে দাঁড়ায় রেকর্ড ৯ হাজার ৩১০ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
পরের দুই অর্থবছর লোকসান কিছুটা কমে সংস্থাটির। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আট হাজার ১৪১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে সাত হাজার ৪৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা লোকসান গুনে পিডিবি। তবে গত অর্থবছর তা আগের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।