মাতৃস্বাস্থ্য ও নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জনসচেতনতা

মো. সাজেদুল ইসলাম : হাসপাতালের এক ভবনের অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও নতুন সংস্কার করা এক কক্ষে আট মাসের প্রসূতি তন্নিমা আক্তার সিনিয়র নার্স আনজুয়ারা বেগমের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আনজুয়ারা আবার একজন প্রশিক্ষিত ধাত্রীও। তিনি তন্নিমার শরীর পরীক্ষা করে এ সময়ে তার কী কী করণীয় সে বিষয়ে তাকে উপদেশ দিলেন। এরপর সবকিছু ঠিকঠাক আছে বলে নার্স তন্নিমাকে জানান, তিনি আগামী পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে বাচ্চা প্রসব করতে পারেন। উপকূলের প্রত্যন্ত জেলা পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রসবপূর্ব সেবাকক্ষের বাইরে গর্ভধারণের বিভিন্ন পর্যায়ের নারীরা তাদের সেবার সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এই হাসপাতালে যে ধরনের মাতৃস্বাস্থ্য সেবা দেয়া হচ্ছে, এটা প্রত্যন্ত এলাকায় খুঁজে পাওয়া সত্যি কঠিন।

বর্ণিত এই ঘটনাটি মাতৃস্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক সংবাদ হলেও এ বিষয়ে পীড়াদায়ক কিছু বিষয়ও আছে। বিগত এক দশকে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পেলেও বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার এখনও অনেক বেশি। তার কারণ হিসেবে গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালে ও প্রসব-পরবর্তী সময়ে দক্ষ সেবাদানকারীর কাছ থেকে সেবা না নেয়া বা সেবা না পাওয়া এবং বাড়িতে প্রসবকে অনেকাংশে দায়ী করা হয়। অশিক্ষা, অজ্ঞতা, দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, কুসংস্কার, নারীর ক্ষমতায়নের অভাব মা ও নবজাতকের মৃত্যুর জন্য অনেকাংশে দায়ী। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বিশেষ করে শিশুমৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে যে কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম, যদিও উন্নত দেশের তুলনায় এখনও বাংলাদেশে নবজাতক এবং শিশুমৃত্যুর হার অনেক বেশি।

বাংলাদেশ ম্যাটারনাল মর্টালিটি অ্যান্ড হেল্থ কেয়ার সার্ভের (বিএমএমএস-২০১০) পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, প্রতিদিন ২০-২৫ মা কোনো না কোনো প্রসব-পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদি জটিলতায় ভোগেন। অন্যদিকে নবজাতকের স্থাস্থ্যের অবস্থাও উন্নত দেশের তুলনায় নাজুক। বছরে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার শিশু জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে মারা যায়। পাঁচ বছরের কম বয়সী যত শিশু মারা যায়, তার শতকরা ৫৭ ভাগ মারা যায় ০-২৮ দিনের মধ্যে, প্রায় ৭৫ ভাগ নবজাতকের মৃত্যু হয় জন্মের সাত দিনের মধ্যে এবং এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকের মৃত্যু হয় জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে। প্রতিদিন প্রায় ২০ মা গর্ভজনিত কারণে মারা যায়, যার বেশিরভাগই সময়মতো যথাযথ সেবা/ব্যবস্থা নিলে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

ইউনিসেফের তথ্যমতে, বাংলাদেশের নারীদের দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টির হার শতকরা ৩৭ দশমিক ৯। খাবারের অপ্রতুলতা, অপুষ্টি ও সচেতনতার অভাবে প্রতিনিয়ত ঘটছে মাতৃমৃত্যু। অপুষ্টিজনিত মাতৃমৃত্যুর ২৫ ভাগই ঘটে রক্তক্ষরণ ও রক্তস্বল্পতার জন্য, যার অন্যতম কারণ কিশোরী মাতৃত্ব।

শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ালে শিশুমৃত্যু হ্রাস পায়। শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুকে সঠিক নিয়মে বুকের দুধ খাওয়ালে শিশুমৃত্যু ২০ শতাংশ হ্রাস পায়। পাশাপাশি শিশুর দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রদত্ত এক তথ্যে বলা হয়েছে, শিশুকে জšে§র পর থেকে প্রথম ছয় মাস শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। এসময় এমনকি পানিরও প্রয়োজন নেই। মায়ের দুধেই রয়েছে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুর প্রয়োজনীয় ভিটামিন, মিনারেলসহ সব ধরনের খাদ্যগুণ। ছয় মাস বয়স থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকে মায়ের দুধের পাশাপাশি ঘরে তৈরি খাবার নরম করে খাওয়াতে হবে।

জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের এক তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে ৬৪ শতাংশ শিশুকেজন্মের পর থেকে প্রথম ছয় মাস মায়ের দুধ খাওয়ানো হয়। অর্থাৎ ৩৬ শতাংশ শিশু মায়ের দুধ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন প্রফেসর ডা. এস কে রায় বলেন, বুকের দুধবঞ্চিত শিশুদের সংক্রমণ বেশি হয় এবং তারা ঘনঘন অসুস্থতায় ভোগে। তাই মায়েদের এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বোঝাতে হবে যে, শিশুকে নিয়মমতো বুকের দুধ খাওয়ানো খুবই জরুরি।

মায়ের ক্ষেত্রে সুবিধা হলো জন্মের পরপরই মায়ের দুধ খাওয়ালে মায়ের রক্তক্ষরণ কম হয়, তাই মা রক্তস্বল্পতার ঝুঁকি থেকে রক্ষা পায়। মায়ের স্তন ও ডিম্বাশয়ের ক্যানসারের সম্ভাবনা কমে। পূর্ণ ছয় মাস দিনে ও রাতে শুধু মায়ের দুধ খাওয়ালে আবার গর্ভধারণের সম্ভাবনাও হ্রাস পায়।

সব গর্ভবতী মাকে উন্নত এবং নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করলে নিরাপদ প্রসব ও সুস্থ শিশুর জš§দান নিশ্চিত করা যায়। ফলে মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যুহার হ্রাস পায়। গর্ভাবস্থায় মাকে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি করে পুষ্টিকর ও সুষম খাবার খেতে হবে (খাবারের তালিকায় সাধ্যমতো ফলমূল, সবুজ শাকসবজি, ডাল, শিম, মাংস, ডিম, দুধ, ছোট মাছ ইত্যাদি থাকতে হবে)।

মাতৃত্বকালীন অপুষ্টি মায়ের স্বাস্থ্যহানি ঘটায়, এমনকি অনেক সময় মা ও নবজাতকের মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দেয়। শিশু বিয়ে, অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, কিশোরী মায়ের পুষ্টিহীনতা, রক্তস্বল্পতা, গর্ভাবস্থায় রক্তক্ষরণ, সুচিকিৎসার অভাব প্রভৃতি কারণে নারীদের নিরাপদে মা হওয়ার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। সুতরাং নবজাতক ও মাতৃমৃত্যু রোধ করতে হলে গর্ভধারণের আগে থেকেই নারীর প্রতি যতœশীল হওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশে ২০১৮ সালে বিভিন্ন রোগ ও নানা কারণে এক লাখ ১৯ হাজারের বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। পৃথিবীর যে ১০টি দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর সংখ্যা বেশি, বাংলাদেশ তার একটি। যুক্তরাজ্যভিত্তিক জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেটের ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বরের সংখ্যায় এ তথ্য দেয়া হয়েছে। ল্যানসেটের তথ্যে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ সময়ের আগে জন্মানোর জটিলতা (২০ শতাংশ) এবং নিউমোনিয়ায় (১৫ শতাংশ)। একই সংখ্যক শিশু মারা যায় জন্মকালে বা প্রসবকালে নানা জটিলতায় (১৫ শতাংশ)। ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব কমে গেছে, এমন কথা বলা হলেও ছয় শতাংশ শিশু এখনও মারা যাচ্ছে ডায়রিয়ায়। ১৪ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে সেপসিস ও মেনিনজাইটিসে। জন্ম গত ত্রুটির কারণে ৯ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। পাঁচ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই ছয় শতাংশ শিশু মারা যায় নানা আঘাতজনিত কারণে।

প্রসবের পর থেকে ৪২ দিন পর্যন্ত মা ও শিশুর অবস্থা নিরূপণ করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করাকে প্রসব-পরবর্তী সেবা বলা হয়। জন্মের পরপর বিশেষ করে প্রথম তিন দিনের মধ্যে দুবার প্রসব-পরবর্তী সেবা গ্রহণ মা ও নবজাতকের জীবন রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মতে, প্রসব-পরবর্তী মা ও নবজাতকের অকাল মৃত্যুর অধিকাংশই যথাযথ প্রসব-পরবর্তী সেবা গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব। কারণ নবজাতকের মৃত্যুর ৫০ শতাংশই ঘটে জন্মের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে, আর প্রায় ৭৫ শতাংশ ঘটে জন্মের সাত দিনের মধ্যে। মাতৃমৃত্যুর বেশিরভাগই ঘটে প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি, সংক্রমণ প্রভৃতি কারণে এবং বেশিরভাগ মাতৃমৃত্যু প্রসব-পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘটে থাকে। তাই মা ও নবজাতকের জীবন রক্ষায় প্রসব-পরবর্তী সেবা গ্রহণ করা জরুরি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ত্রীরোগ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপিকা ডা. সুলতানা জাহান তার এক নিবন্ধে বলেন, প্রসবোত্তর সংক্রমণ প্রতিরোধ করা খুব সহজ যদি দেশের প্রতিটি গ্রাম পর্যায়ে ধাত্রীদের স্বাস্থ্যসম্মতভাবে প্রসব সম্পর্কে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। প্রতিটি ঘরে পরিবারের কল্যাণের কথা পৌঁছে দিতে পারলে এবং প্রতিটি গর্ভবতীর উপযুক্ত অ্যান্টিনেটাল চেক আপ ও প্রসবের সুপ্ত ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশে এসব প্রতিরোধযোগ্য রোগে মায়ের মৃত্যুহার অনেকটা কমিয়ে আনা যায় বলে তিনি মনে করেন।

সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের ফলে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার সন্তোষজনকভাবে কমেছে। মায়েদের গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর স্বাস্থ্যসেবা ২০০১ সালে পাঁচ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৬ সালে ৪৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসব ২০১০ সালে ২৩ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৬ সালে ৪৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ভিশন ২০২১ অনুযায়ী মাতৃমৃত্যুর হার এক দশমিক ৪৩-এ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির মাধ্যমে ২০২২ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার এক দশমিক ১২ শতাংশে কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে।

মাতৃমৃত্যু হার হ্রাসের লক্ষ্য অর্জনে সারাদেশে সব পর্যায়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সেবার মান ও পরিধি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশে গত প্রায় এক দশকে (২০০১-২০১০) মাতৃমৃত্যুর হার ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের মাধ্যমে অধিকতর টেকসই ও সুন্দর বিশ্ব গড়ার প্রত্যয় নিয়ে সর্বজনীনভাবে একগুচ্ছ সমন্বিত কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। এতে ১৭টি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ও ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। টেকসই অভীষ্টের তিন দশমিক দুই হলো ২০৩০ সালের মধ্যে নবজাতক ও পাঁচ বছর বয়সের নিচে শিশুদের প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু নাশ করা। এটি বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের।

সুবিধাবঞ্চিত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে সরকার স্বাস্থ্যসেবাকে প্রান্তিক মানুষের হাতের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। গর্ভবতী মায়ের প্রসবপূর্ব, প্রসবকালীন ও প্রসবোত্তর সেবা নিশ্চিত করার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এসব কেন্দ্র থেকে অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি গর্ভবতী মহিলাদের অত্যাবশ্যকীয় সেবা প্রদান এবং কোনো জটিলতা দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব প্রসূতিকে জরুরি প্রসূতি সেবাকেন্দ্রে পাঠানো নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

পিআইডি নিবন্ধন

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০