জয়নাল আবেদিন: নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই ঋণ অনুমোদন করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড। ঋণ পেতে ব্যাংকের কাছে যে সম্পত্তি বন্ধক রাখা হয়েছে, তার আসল কাগজ অন্য ব্যাংকের কাছে। একই জমির কাগজ দেখিয়ে পূবালী ও অগ্রণী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে স্টাইলক্র্যাফট নামের পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান। এতে আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরও নানা তদবির ও সুপারিশের মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে মোট ৩৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে অগ্রণী ব্যাংক।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণে এসব অনিয়ম উঠে এসেছে। বিভিন্ন চাপে প্রশ্নবিদ্ধ পোশাক তৈরি প্রতিষ্ঠান স্টাইলক্র্যাফটকে ঋণ দিতে অনুমতি দেয়া হয়েছে। তবে বিতরণের জন্য জুড়ে দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি শর্ত। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, সম্পত্তির মূল দলিল গ্রহণ, রাজউকের অনাপত্তি, পূবালী ব্যাংকের অনাপত্তি, এই কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত ব্যাংকারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং পরবর্তী বোর্ড সভায় আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের শর্তগুলো উপস্থাপন করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েক দিন ধরে ছয় মাসের বকেয়া মজুরির দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন স্টাই ক্র্যাফটের শ্রমিকরা। এরই ধারাবাহিকাতায় আজ বিজয়নগরের শ্রম ভবন থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে মিছিল ও স্মারকলিপি প্রদান কার্যক্রম রেখেছেন তারা। শ্রমিকরা জানান, এর আগে মালিকপক্ষ গাজীপুরে লিখিত ও মৌখিক চুক্তি সাতবার ভঙ্গ করার পর দুই দফায় তিন দিন তারা বিজিএইএ কার্যালয়ের সামনে অবস্থান করেন। মজুরি পরিশোধ করার দাবিতে গত ২৬ অক্টোবর থেকে তারা শ্রম ভবনে লাগাতার অবস্থান করছেন। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে তারা জানান।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, স্টাইলক্র্যাফট বেসরকারি পূবালী ব্যাংকে সম্পত্তির প্রকৃত নথি/দলিল রাখা সত্ত্বেও অগ্রণী ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে ঋণ অনুমোদন করেছে। কিন্তু রাজউক (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) থেকে অনাপত্তি নেয়া ছিল পূর্বশর্ত।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নিয়ম অনুযায়ী প্রস্তাবিত সম্পত্তির প্রকৃত নথি, বায়া দলিল, সিএস, এসএ, আরএস, মিউটেশন পর্চা, ডিসিআর, সর্বশেষ ভূমি করের রশিদ ও নির্দায় সনদপত্র ছাড়া এই কোম্পানির অনুকূলে ঋণ দেয়া যাবে না। তার পরও ঋণটি অনুমোদন করা হয়েছে, যা গুরুতর আনিয়ম। অনিয়মের মাধ্যমে সম্পত্তি বন্ধক কার্যক্রমে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যাংকের আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অগ্রণী ব্যাংককে গত ১৩ অক্টোবর চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এই পদক্ষেপের আগে তিন পরিচালকের আপত্তি সত্ত্বেও অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ তার ৭৪৭তম সভায় পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে ২৫ কোটি টাকার সিসি এবং ১০ কোটি টাকার ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সীমা অনুমোদন করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানটি শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন ও অন্যান্য খরচ পরিশোধের জন্য চলতি বছরের ১৮ মে অগ্রণী ব্যাংকের কাছে চলতি মূলধন ঋণের জন্য আবেদন করে এবং প্রকৃত চাহিদার যথাযথ মূল্যায়ন না করেই ঋণ অনুমোদন করে। এছাড়া বন্ধকী দলিল সম্পাদন করা হয়েছে গুলশান সাবরেজিস্ট্রি অফিসে। বন্ধকদাতা ডা. আলমাস বেগমের স্বাক্ষরের পরিবর্তে টিপসই প্রদান করা হয়। এতে সার্বিক প্রক্রিয়াটি সন্দেহজনক বলে প্রতীয়মান হয়। আবার মূল দলিল না থাকার কারণে আইনগত প্রক্রিয়ায় ঋণ আদায় করতে হলে সম্পত্তি বিক্রি করে অর্থ আদায় সম্ভব হবে না।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, বন্ধকের জন্য প্রস্তাবিত সম্পত্তির মালিক স্টাইল ক্রাফটের মালিকের মা। সম্প্রতি তার মা মারা গেছেন এবং সে কারণে বন্ধকী সম্পত্তির প্রকৃত দলিল নিতে সমস্যা হয়েছে। তবে এখনও এক টাকাও বিতরণ করা হয়নি। আমরা আবারও বিষয়টি আমাদের পরবর্তী পরিচালনা পর্ষদের সভায় রাখব এবং সভার আগে প্রকৃত নথি সংগ্রহ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, স্টাইলক্র্যাফট লিমিটেড একটি রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান। তবে আর্থিক সংকটের কারণে কয়েক দিন বন্ধ থাকলেও এটি একটি মানসম্মত পোশাক কোম্পানি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বেসরকারি পূবালী ব্যাংক স্টাইলক্র্যাফটকে ২০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সময়মতো সম্পত্তি বন্ধক রাখতে না পারায় ব্যাংকটি পাঁচ কোটি টাকা দেয়। প্রতিষ্ঠানটি গত কয়েক বছরে ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও মুনাফা কমে যাওয়ায় কোম্পানিটিকে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ব্যাংক আর বাড়ায়নি। এরপর প্রতিষ্ঠানটি অগ্রণী ব্যাংকে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লোনের জন্য আবেদন করে, যা অনুমোদনও করেছে ব্যাংকটি।
এ বিষয়ে স্টাইলক্র্যাফট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শামস আলমাস রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
মন্তব্য