নবায়নযোগ্য সম্পদের টেকসই ব্যবহার

তোফাজ্জল হোসেন: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বর্তমান বিশ্বে একটি অন্যতম আলোচিত বিষয় নবায়নযোগ্য শক্তি বা জ্বালানি। বিশ্বের জনসংখ্যা দিন দিন যেমন বাড়ছে, তেমনি ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও জনপদগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য শক্তির চাহিদাও ততই বাড়ছে। শক্তির টেকসই স্তর বজায় রাখতে এবং পৃথিবী নামক গ্রহকে জলবায়ু পরিবর্তন থেকে রক্ষা করার জন্য নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলোর উদ্ভাবন ও এর সম্প্রসারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুন কিছু আবিষ্কার মানেই যে সংযোজন হওয়া, তা নয়, কিছু বিষয় বিয়োজনও হয়। কোনো ক্ষেত্রে বিয়োজন বা বিলুপ্তি চোখে দেখা যায়, আবার কিছু দেখা যায় না। আবার যেগুলো দেখা যায় না, সেগুলোর সিংহভাগই পরিবেশের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। এতে আবিষ্কারের চেয়ে বেশি জরুরি পুরোনোকে পুনর্ব্যবহার বা রিসাইকেল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নবায়ন করে কাজে লাগানো। বর্তমানে সময়োপযোগী ও বিজ্ঞানভিত্তিক একপ্রকার শক্তি হলো নবায়নযোগ্য শক্তি বা জ্বালানি। নবায়নযোগ্য শক্তি হলো এমন এক শক্তির উৎস, যে শক্তি বারবার ব্যবহার করার পরও নিঃশেষ হয় না, অর্থাৎ একবার ব্যবহার করার পর আবার ব্যবহার করা যায়। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎসের মধ্যে সৌরশক্তি, হাইড্রো, জিয়োথারমাল, ওয়েভ এবং টাইডাল এনার্জি, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈবশক্তি, ভূ-তাপ, সমুদ্রতরঙ্গ, সমুদ্র-তাপ, জোয়ার-ভাটা, শহুরে আবর্জনা ও হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল উল্লেখযোগ্য। নবায়নযোগ্য শক্তিকে কখনও সবুজ শক্তি বা পরিষ্কার শক্তি নামেও অভিহিত করা হয়। এসব শক্তির উৎস অফুরন্ত। বর্তমান বিশ্বে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বর্তমানে অধিকাংশ দেশ তাদের  বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা মেটাতে নবায়যোগ্য শক্তি ব্যবহার করেছে। নবায়নযোগ্য শক্তিগুলো পরিবেশবান্ধব এবং কার্বন নিঃসরণমুক্ত। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থায় পৌঁছানোর জন্য জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদী আন্দোলনগুলো নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে উৎসাহ অব্যাহত রেখেছে। বিভিন্ন ধরনের নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের মধ্যে সৌরশক্তি সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এবং বায়োগ্যাস ও বায়োমাসের রয়েছে সীমিত ব্যবহার।

নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে টেকসই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, যানবাহন ব্যবস্থা ও গ্রিন টেকনোলজি-সমৃদ্ধ শক্তিসাশ্রয়ী গৃহস্থালি পণ্য প্রবর্তনে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন গবেষণা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রচলিত বিদ্যুৎ সরবরাহবিহীন জায়গাগুলোয় জনসাধারণ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। এখন বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রেণির নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহƒত হচ্ছে। বিশ্বে অন্যতম কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানি, রাশিয়া ও ভারত সবচেয়ে বেশি নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করছে। নর্ডিক দেশগুলো নবায়নযোগ্য শক্তিবান্ধব আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এর প্রসার ঘটাতে সাহায্য করছে। বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ নবায়নযোগ্য শক্তি বৃদ্ধির জন্য নীতি গ্রহণ করেছে। জীবাশ্ম জ্বালানির বিভিন্ন উৎস, যেমনÑপ্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, খনিজ তেল ইত্যাদি ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে সহজে নিঃশেষ হয়ে যায়।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের মতে, বর্তমানে দেশের দুই দশমিক ৮৬ শতাংশ বিদ্যুৎ সৌরশক্তিসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসে। নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলো বর্তমানে বিশ্বের বিদ্যুতের ২৬ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে। তবে আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার (আইইএ) মতে, ২০২৪ সালে এর শেয়ারের পরিমাণ ৩০ শতাংশে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইএএ) বিগত ২০১১ সালের প্রকল্প অনুসারে, সৌরশক্তি জেনারেটর ৫০ বছরের মধ্যে ক্ষতিকারক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে বলে প্রত্যাশা করা হয়।

বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়-সংক্রান্ত ঝুঁকি হ্রাস এবং জ্বালানি নিরাপত্তার প্রয়োজনে জীবাশ্ম-জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার হওয়া আবশ্যক; জ্বালানি সংরক্ষণ ও তার দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানির অপচয় রোধ করা দরকার। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে পরিবেশ দূষণ ও অবক্ষয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রকৃতি, পরিবেশ ও সম্পদের ভিত্তি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত বিধায় স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ এবং বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সংরক্ষণ ও সব ধরনের সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা আবশ্যক। প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণ, ব্যবহার ও পরিবেশ সংরক্ষণ প্রভৃতি বিজ্ঞানভিত্তিকরণ করতে হবে। পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য নবায়নযোগ্য সম্পদের টেকসই ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার কমিয়ে পুনর্ব্যবহার বা রিসাইকেল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। দূষণরোধকল্পে শূন্য নির্গমন, পানি ও প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার ও পুনঃচক্রায়ন ব্যবস্থা এবং বর্জ্য পরিশোধন করতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তি সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে জ্বালানি সংরক্ষণে সচেতনতামূলক প্রচারণা শুরু করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। এছাড়া স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নবায়নযোগ্য শক্তি সংরক্ষণ এবং প্রয়োগের বিষয়ে বাস্তবসম্মত শিক্ষাদান প্রয়োজন। নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে প্রধান নির্ভরতা করতে প্রয়োজন প্রযুক্তি। তাহলেই জীবাশ্ম জ্বালানির এই কুফল থেকে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজম্মকে সুন্দর এবং কার্বনমুক্ত বসুন্ধরা উপহার দিতে পারব।

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০