ড. শিল্পী ভদ্র: জেনেটিক ত্রুটির কারণে জন্ম নেয়া শিশু পরবর্তী সময়ে ‘হিজড়া’ নামে অভিহিত হয়। ‘হিজড়া’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ নপুংসক অর্থাৎ না নারী, না পুরুষ। জন্মগত এই ত্রুটির কারণেই প্রিয়জনের কাছ থেকে অবহেলা, অবজ্ঞা পেয়ে এই জনগোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পরিবার থেকে। বঞ্চিত হয় তারা, তাদের প্রাপ্য অধিকারথেকে। যদিও সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানে প্রতিটি মানুষের মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকারের কথা উল্লেখ রয়েছে।
বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানে আছে, ‘হিজড়া’ শব্দটি হিন্দি ভাষা থেকে এসেছে। যার অর্থ একই দেহে স্ত্রী ও পুরুষের বৈশিষ্ট্যযুক্ত মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণী, (ঐবৎসধঢ়যৎড়ফরঃব)। পরিভাষায় ত্রুটিপূর্ণ যৌনাঙ্গ বা মিশ্র যৌন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষকে বৃহন্নলা (হিজড়া) বলা হয়। যৌন বৈচিত্র্যের ভিত্তিতে মোট চার ধরনের হিজড়ার অস্তিত্ব পাওয়া যায়
ক. ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামী পুরুষ, তবে তারা নারীর বেশে চলে; খ. ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামী নারী, তবে দৈহিক গঠনে পুরুষের ছাপ আছে। যেমনÑ দাড়ি ও গোঁফ থাকা; গ. আর, ইন্টারসেক্স বা আন্তলিঙ্গদের লিঙ্গ দেখে বোঝা যায় না যে, শিশুটি ছেলে নাকি মেয়ে। আর এরকম শিশুদের বলা হয় ইন্টারসেক্স (রহঃবৎংবী) বা আন্তলিঙ্গ। এরাই প্রকৃতপক্ষে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে বিবেচিত; ঘ. কৃত্রিমভাবে যৌনক্ষমতা নষ্ট করে হিজড়াদের শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে; যাদের খোঁজা বলা হয়। যৌন অক্ষমতার দরুন তাদের বিয়েও বৈধ নয়।
অনেকের ধারণা, যারা ট্রান্সজেন্ডার বা ইন্টারসেক্স হয়ে জš§ায়, এটা বোধহয় তাদের চিরনিয়তি। এভাবেই হয়তো তাদের চিরদিন থাকতে হবে। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতি এনে দিয়েছে এ সমস্যার সমাধান। এ জন্য প্রয়োজন শুধু আমাদের সচেতন হওয়া, অন্যদের সচেতন করা এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করা।
হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সরকার ইতোমধ্যে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি মন্ত্রিসভা কর্তৃক হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান ও তালিকাভুক্ত করা সরকারের একটি উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত। হিজড়া সম্প্রদায় অনেকদিন ধরে সরকারের কাছে যে দাবি করে আসছিল। এই ঘোষণা বাংলাদেশের হিজড়া সম্প্রদায়ের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশের হিজরা সম্প্রদায় ২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকায় প্রথমবারের মতো ‘হিজড়া প্রাইড ডে’ উদযাপন করেন। এই সমাবেশে অন্তত ১ হাজার হিজড়া অংশ নেন।
২০১৯ সালে হিজড়ারা স্বতন্ত্র লিঙ্গীয় পরিচয়ে ভোটাধিকার লাভ করেন। বর্তমানে তারা পাসপোর্ট কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্রে লিঙ্গীয় পরিচয় হিসেবে হিজড়া যুক্ত করতে পারেন।
তারপরও হিজড়া সম্প্রদায় সমাজের মূলস্রোতধারার বাইরেই আছেন। নানা কারণে তারা উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে-পড়াদের অন্তর্ভুক্ত। যখন দেশ উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এই মানুষগুলোর টেকসই দারিদ্র্য বিমোচন জরুরি। টেকসই উন্নয়ন ধারণার দাবিও তাই।
হিজড়াদের মূলস্রোতধারায় সম্পৃক্তকরণে সরকার তাদের জীবন-জীবিকায়নে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতাভুক্ত করাসহ কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে। তবে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। এ থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজন হিজড়া জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ। এই উদ্যোগের যথাযথ বাস্তবায়ন একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয় এবং সময়সাপেক্ষও বটে। কারণ এই সম্প্রদায়ের রয়েছে ভিন্নতর পেশা; যা সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত নয়। এ ছাড়া তাদের মনোজগতের রয়েছে এক ভিন্ন মাত্রার জৈবিক চাহিদা। এটাও বহমান জীবন ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সমাজ জীবনে এই চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করে এই জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলস্রোতে সম্পৃক্ত করা একটি কঠিন কাজ।
বাংলাদেশে হিজড়াদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে রয়েছে অস্পষ্টতা। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে হিজড়াদের সংখ্যা ২৪ হাজারের কিছু বেশি। অন্যদিকে হিজড়া কল্যাণ ফাউন্ডেশনের দাবি বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ লাখ। সরকারি হিসাবে, দেশে হিজড়াদের সংখ্যা ১০ হাজার (ব্র্যাক ২০১৪)। সামাজিক বিধিনিষেধ, মূল্যবোধ ও ডাক্তারি-নিরীক্ষা জটিলতার কারণে অনেক হিজড়াই নিজেদের সরকারিভাবে নথিভুক্ত করেনি বলে হিজড়াদের প্রকৃত সংখ্যায় এত বৈষম্য রয়েছে।
পৃথক লিঙ্গীয় পরিচয়ের কারণে হিজড়ারা মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। পরিবারের কাছে তারা কোনো সম্পদ হিসাবে বিবেচিত হয় না। সাধারণত সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত হন। তাই তাদের আর্থসামাজিক ও স্বাস্থ্যগত দিক হুমকিতে পতিত হয়।
হিজড়াদের পারিবারিক সম্পত্তির অধিকার এবং জীবনমান উন্নয়নে সরকার পদক্ষেপ গ্রহণে সংবেদনশীল। হিজড়াদের মা-বাবার সম্পত্তির সমান ভাগ নিশ্চিত করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিবিসিকে বলেছেন, মুসলিম শরিয়া আইন এবং বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে এ বিষয়ে তারা ব্যবস্থা নেবেন।
স্বাভাবিক কর্মসংস্থান ও আয়-রোজগারের সুযোগ না থাকায় জীবিকার প্রয়োজনে কিছু নির্দিষ্ট উপায়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন, যা ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনিশ্চয়তায় ঘেরা। একইসঙ্গে জীবিকা নির্বাহের এই উপায়সমূহ সমাজে বিতর্কিত।
দেশের দলবদ্ধ হিজড়া সম্প্রদায় মূলত যেসব কাজ করে জীবন নির্বাহ করে থাকেন তা হলোÑযাত্রা পথে, ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকা গাড়ির যাত্রী, বাসা-বাড়ি, দোকান, পথচারী কিংবা বিয়ে-পূজা অথবা যে কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে টাকা উঠানো। তাছাড়া কোনো বাড়িতে নবজাতকের জš§ হয়েছে, সংবাদ পেলে সেখানে তারা দল বেঁধে উপস্থিত হন এবং অনেকটা জোর টাকা আদায় করেন। তারা মূলত নাচ-গান গেয়ে টাকা উঠানো, শিশু নাচানো, সৌন্দর্যায়নের (বিউটি পার্লার) কাজ, শরীর মেসেজের কাজ করেন। যৌনকর্মী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন, যার সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বলে জানা যায়। হিজড়াদের কিছু দল রয়েছে যারা গ্রামগঞ্জে পালাগানের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেন।
মূলত এ রকম ‘রাস্তাঘাটে, বাজারে কিংবা বাসাবাড়িতে চাঁদা উত্তোলনকে অনেকেই অনৈতিক, বেআইনি কিংবা সন্ত্রাসমূলক কার্যক্রম হিসেবে দেখে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা কিংবা সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। কিছু হিজড়া সদস্য বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের (যেমন শিশু ছিনতাই, সংঘর্ষ, হত্যা প্রভৃতি) সঙ্গে জড়িত হয়েছিল বলেও বিভিন্ন সময়ে জাতীয় দৈনিকসমূহে প্রকাশিত হয়েছে (গোলাম মোরশেদ, বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ ও সম্ভাবনা, বাংলা ট্রিবিউন, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১)’।
বর্তমানে হিজড়াদের নাগরিকত্ব ও তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তাদের পুনর্বাসনে, চাকরিতে নিয়োগ ও আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে হিজড়াদের জন্য একটি তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। সরকার হিজড়াদের ট্রাফিক পুলিশে নিয়োগ দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এসব বিচ্ছিন্ন উদ্যোগের ফলে তাদের জীবনমান ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে।
বর্তমানে সারাবিশ্বেই হিজড়ারাও অন্য লিঙ্গের মানুষের মতোই এগিয়ে যাচ্ছে। যেমন ২০১৫ সালে ভারতে হিজড়া সদস্য কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি আবেদন ফরমে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য পৃথক কলাম রেখেছে। বাংলাদেশেও কিছু কিছু হিজড়া সদস্য বিভিন্ন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। যেমন ২০১৮ সালে প্রথম হিজড়া সদস্য হিসেবে তানিশা ইয়াসমিন চৈতি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। ট্রাফিক পুলিশ, গণবিশ্ববিদ্যালয়, স্কয়ার হাসপাতাল, আইসিডিডিআর,বি ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হিজড়াদের নিয়োগের খবর পাওয়া যায়। আবার কেউ কেউ উদ্যোক্তা হিসেবে বিউটি পার্লার, সেলাইয়ের কাজ কিংবা পোশাকের বিপণন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন।
বাংলাদেশ সরকার হিজড়াদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছরে হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল। এই প্রকল্পের অধীন স্কুলগামী হিজড়া শিক্ষার্থীদের মাসিক উপবৃত্তি; ৫০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের বিশেষ ভাতা; কর্মক্ষম হিজড়া জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং প্রশিক্ষণোত্তর আর্থিক সহায়তা চালু করা হয়। সমাজে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার এ জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, আর্থসামাজিক, শিক্ষা ব্যবস্থা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সমাজের মূলধারায় যুক্ত করে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সরকার এ কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল।
২০১২-১৩ অর্থবছরে ৭২ কোটি ১৭ লাখ টাকা বরাদ্দে পাইলট কর্মসূচি হিসেবে দেশের সাতটি জেলায় (ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, পটুয়াখালী, খুলনা, বগুড়া এবং সিলেট) প্রথম হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু হয়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নতুন ১৪টি জেলাসহ মোট ২১টি জেলায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের কর্মসূচির বরাদ্দ ৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৪ জেলায় সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৪ জেলায় বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। সমাজসেবা কার্যালয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ৫০ দিনব্যাপী এ কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল। চলতি জীবনধারা থেকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প কর্মসূচির অধীনে এই ধরনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। এ ছাড়া হিজড়াদের কল্যাণ ও পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে ২০১৪ সালে সমাজসেবা দপ্তরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছিল এবং এতে সারাদেশের ৪০ জন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাসকৃত হিজড়া সদস্য আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু ডাক্তারি পরীক্ষা জটিলতায় তা স্থগিত করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সহায়তায় শেরপুর সদর উপজেলার কামারিয়া ইউনিয়নের আন্ধারিয়া সুতিরপাড় গ্রামের দুই একর খাসজমিতে ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ নামের গুচ্ছগ্রাম তৈরি হয়েছে। সেখানে ৪০ জন হিজড়ার নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জমিসহ ঘর। সঙ্গে রয়েছে রান্নাঘর ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার। ঘর পেয়ে খুশি হিজড়া সম্প্রদায়ের সদস্যরা। ‘জেলা প্রশাসক আনার কলি মাহবুব আনুষ্ঠানিকভাবে হিজড়া সদস্যদের কাছে এসব ঘর হস্তান্তর করেন, (হিজড়া সম্প্রদায়ের ৪০ জন পেলেন ঘর, প্রতিনিধি, প্রথম আলো ৭ জুন ২০২১)’। অনুষ্ঠানে জেলা জাতীয় মহিলা সংস্থার পক্ষ থেকে ৪০ জন হিজড়ার প্রত্যেককে ১৫ হাজার টাকা করে আর্থিক অনুদান এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাদ্যসামগ্রী ও তৈজসপত্র দেয়া হয়। পরে জেলা প্রশাসক গুচ্ছগ্রামের পুকুরে মাছের পোনা অবমুক্ত ও গুচ্ছগ্রাম প্রাঙ্গণে গাছের চারা রোপণ করেন।
তবে দেখা যায়, হিজড়াদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো আশানুরূপ সফলতার মুখ দেখেনি। এর কারণ হিসেবে বলা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করেন দাতা পক্ষ। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পেই উপকারভোগীদের যুক্ত করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
গবেষকদের মতে, হিজড়াদের মূলধারার কর্মসংস্থানের অন্তর্ভুক্ত করতে নিন্মোক্ত কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার। যেমনÑএক. পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা ঠেকানো (তাহলে সকল প্রকার বৈষম্যের অনেকাংশই প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে); দুই. সমাজে হিজড়াদের সকল প্রকার লিঙ্গীয় বৈষম্য হ্রাসে তাদের শতভাগ শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে; তিন. সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোটা ব্যবস্থার পাশাপাশি নিয়োগে হিজড়াদের অগ্রাধিকার দিতে হবে; চার. যেহেতু এখন পর্যন্ত তাদের শিক্ষার হার অতিসামান্য (২ শতাংশ), এজন্য শিক্ষাগত ও অন্যান্য যোগ্যতা অনুযায়ী যথাযথ পদে চাকরির সুযোগ প্রদান করতে হবে; পাঁচ. বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিকসহ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন পদে (যেমন অফিস সহকারী, রাঁধুনি, কম্পিউটার অপারেটর প্রভৃতি) স্বল্পশিক্ষিত হিজড়াদের নিয়োগ দিতে হবে। তাদের জন্য লিঙ্গবান্ধব কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা আরও সুসংগঠিত করতে হবে, বিশেষত যৌনকর্মীদের ক্ষেত্রে; সাত. একইসঙ্গে একজন হিজড়া সহকর্মীর সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে আর কোনো আচরণ করা যাবে না এ বিষয়ে অন্য লিঙ্গের (নারী ও পুরুষ) কর্মীদেরও পাঠগ্রহণ দরকার; আট. হিজড়াদের কর্মমুখী প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। নয়. সমাজে চর্চিত সব ধরনের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের পরিবর্তন আনতে হবে।
এসব সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে সরকারসহ সমাজের সবাই তৎপর হলে স্বাভাবিক নারী-পুরুষের মতোই হিজড়ারাও তাদের সৃজনশীলতা ও পারদর্শিতা দিয়ে কর্মক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম বলে গবেষকরা মনে করেন।
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অধিকার বাস্তবায়নে সরকার, বেসরকারি সংগঠন, গণমাধ্যম, দেশবাসীর সহানুভূতি নিয়ে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। কর্মসূচি ঘোষণার পাশে তার যথাযথ বাস্তবায়নে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আর বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে তাদের কল্যাণে কাজ করলে সমাজের এই অবহেলিত জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় সম্পদে পরিণত হবে।
পিআইডি নিবন্ধন