নিজস্ব প্রতিবেদক: রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরীক্ষাগুলো নেয়া হয়। কিন্তু সম্প্রতি চারটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটে। গতকাল এ প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত এক চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। চক্রটি এ পর্যন্ত পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৬০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এদিকে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার ঘটনায় সর্বশেষ অনুষ্ঠিত হওয়া পরীক্ষা নেয়ার দায়িত্বে থাকা বেসরকারি খাতের আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে কারণ দর্শাতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি এ নির্দেশনা দেয়। এতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আগামী ১৪ নভেম্বরের মধ্যে এ বিষয়ে লিখিত আকারে ব্যাখ্যা দিতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘পরীক্ষা গ্রহণ, ব্যবস্থাপনা, প্রশ্নপত্র তৈরি ও সংরক্ষণের যাবতীয় দায়িত্ব ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস ও অবৈধ আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে এসেছে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৪ নভেম্বরের মধ্যে কারণ দর্শানোর জন্য নোটিস দেয়া হয়েছে। তাদের ব্যাখ্যা পেলে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।’
প্রসঙ্গত, পাঁচটি ব্যাংকে অফিসার (ক্যাশ) পদে এক হাজার ৫১১ জনকে নিয়োগ দিতে ৬ নভেম্বর বিকালে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বিকাল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে এমসিকিউ পদ্ধতিতে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই উত্তরসহ প্রশ্নপত্র ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়।
পরের দিন প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। দাবি করা হয়, পরীক্ষা বাতিল করার। বিষয়টি তখন থেকেই আলোচিত হয়।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। এ সময় জানানো হয়, গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচ সদস্যের মধ্যে দুজন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তা। তারা পরপর চারটি ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন। প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকে জানিয়েছেন তারা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) একেএম হাফিজ আক্তার জানান, চক্রটি এ পর্যন্ত প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। ডিবি জানায়, গ্রেপ্তার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রশ্নপত্র প্রণয়নসহ পরীক্ষা আয়োজনে দায়িত্বপ্রাপ্ত আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগ থেকে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে।
গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগের জোনাল টিম ৬ থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিশেষ অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন, মূল হোতা আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি টেকনিশিয়ান মোক্তারুজ্জামান রয়েল (২৬), জনতা ব্যাংকের গুলশান শাখার অফিসার শামসুল হক শ্যামল (৩৪), রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার জানে আলম মিলন (৩০), পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান মিলন (৩৮) ও চাকরিপ্রার্থী রাইসুল ইসলাম স্বপন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হবেÑ৫ নভেম্বর রাতে এমন তথ্য পায় ডিবি। তখন ডিবির টিমের সদস্যরা ছদ্মবেশে পরীক্ষার্থী সেজে ৬ নভেম্বর সকাল ৭টায় প্রশ্নপত্রসহ উত্তর পাওয়ার জন্য চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অগ্রিম টাকা পরিশোধের পর প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা রাইসুল ইসলাম স্বপন ডিবির ছদ্মবেশী পরীক্ষার্থীকে নিয়ে যান। এরপর পরীক্ষার উত্তরপত্রসহ স্বপনকে হাতেনাতে আটক করা হয়।
৬ নভেম্বর পরীক্ষায় আসা প্রশ্নের সঙ্গে সকালে পাওয়া প্রশ্ন ও উত্তর হুবহু মিলে গেলে স্বপনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে রূপালী ব্যাংকের সাভার শাখার শ্রীনগর থেকে জানে আলম মিলনকে গ্রেপ্তার করা হয়। রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার জানে আলম মিলনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র সরবরাহকারী শামসুল হক শ্যামলকে ধরতে প্রথমে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে অভিযান চালানো হয়। পরে জানা যায়, শ্যামল ঢাকায় অবস্থান করছেন। এরপর ঢাকার দক্ষিণ বাড্ডা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে প্রশ্নপত্রসহ উত্তরপত্র ফাঁস করার কথা স্বীকার করেন শামসুল হক শ্যামল। তার দেয়া তথ্যে চক্রের মূল হোতা মুক্তারুজ্জামান রয়েলকে বাড্ডার আলিফনগর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। মুক্তারুজ্জামান আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে আইসিটি টেকনিশিয়ান (হ্যার্ডওয়ার ও সফটওয়ার) হিসেবে কাজ করেন। আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অন্য সহযোগীদের সহায়তায় প্রশ্ন ও উত্তরপত্র সংগ্রহ করার কথা স্বীকার করেন তিনি।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, মোবাইল ফোনে থাকা তথ্য ও হোয়াটস অ্যাপ চ্যাটের তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর লালবাগ থেকে প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের আরেক অন্যতম হোতা পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান মিলনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, পরীক্ষার আগে চক্রের সদস্যরা রাজধানীর বাড্ডা, বসুন্ধরা, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, রূপনগর, মিরপুর, মাতুয়াইল, শেওড়াপাড়া, শেরেবাংলা নগর ও পল্লবী এলাকায় নিজেদের বুথ বসায়। এসব বুথে পরীক্ষার পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা আগে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের ফাঁস করা প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করানো হয়। চক্রের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক বুথ থেকে ২০ থেকে ৩০ পরীক্ষার্থীকে উত্তর মুখস্থ করিয়ে কেন্দ্রে পাঠানো হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে মুক্তারুজ্জামান রয়েল ও শ্যামল জানান, এর আগে আরও তিনটি বিভিন্ন ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও উত্তর ফাঁস করেছেন তারা। নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে পাঁচ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। চক্রটি এ পর্যন্ত ৬০ কোটি টাকা হাতিয়েছে বলে জানতে পেরেছে ডিবি।
এক প্রশ্নের জবাবে ডিবির এ কর্মকর্তা বলেন, এই প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ চক্রে আরও যারা জড়িত, তাদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চলছে।