সামিহা খাতুন: ‘চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ। প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য কথাটি বলেছেন তার কবিতায়, অনেক আগে। কিন্তু আজও এই কবিতা সমভাবে প্রাসঙ্গিক সমাজের জঞ্জালের কারণে।
জš§ই যেন আজš§ পাপ। মাতৃ জরায়ু থেকে নেমেই বুঝে যায় দুনিয়া কত কঠিন, কত নির্মম-নিষ্ঠুর। পথে পথে ঘুরে কখনও পরিচয় টোকাই হিসেবে, কখনও বা পথশিশু। একটি শিশু ও পথশিশুর মাঝে কোনো পার্থক্য না থাকলেও আমাদের সমাজ পরিবেশ আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট একটি সাধারণ শিশু ও পথশিশুর মাঝে বিস্তর পার্থক্য সৃষ্টি করে দিচ্ছে। পথশিশু শব্দটি সেসব শিশুকে প্রকাশ করে, যাদের কাছে রাস্তাই (বিস্তৃত অর্থে বস্তি, পতিত জমি প্রভৃতিও এর অন্তর্ভুক্ত) তাদের স্বাভাবিক বাসস্থান এবং/অথবা জীবিকা নির্বাহের উৎস হয়ে উঠেছে এবং তারা দায়িত্বশীল কোনো প্রাপ্তবয়স্ক কর্তৃক সুরক্ষিত, পথ নির্দেশনা প্রাপ্ত ও পরিচালিত নয়।
আমাদের দেশের পথশিশুদের কুলি, হকার, রিকশাচালক, শ্রমিক, ফুলবিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, হোটেল শ্রমিক, বুননকর্মী, মাদক বাহক, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক ইত্যাদিসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করা হয়।
২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ছিল ১০ লাখ, যার মধ্যে আড়াই লাখের বেশিই ছিল রাজধানীতে। বর্তমানে বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। কেউ বলেন ২১ লাখ। আবার কেউ বলেন ২৪ লাখ। তবে এদের মধ্যে ৫০ হাজার শিশু আক্ষরিক অর্থেই রাস্তায় থাকে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পথশিশুদের ৫১ শতাংশ ‘অশ্লীল কথার শিকার’ হয়। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয় ২০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয় মেয়েশিশু। ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ পথশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আর মেয়ে পথশিশুদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার।
পথশিশুদের নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (লিডো)। লিডোর তথ্যমতে, পথশিশুদের কেউ কেউ মাদকাসক্ত হয়ে রাস্তায় মারা যায়। কেউ কেউ বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়ে যায়। যারা পাচারের শিকার হয়, তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হয়। নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় তারা। যারা মেয়ে, তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কোনো কোনো গ্যাং তাদের যৌনকর্মী হতে বাধ্য করে। এছাড়া অপরাধী চক্রগুলো এদের মাদকসহ নানা অবৈধ ব্যবসায় কাজে লাগায়। এরা আসলে অপরাধী নয়। এরা অপরাধের শিকার হয়। রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের নানা কাজে ব্যবহার করে।
সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক ইনহান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ) নামের একটি সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পথশিশুদের প্রায় ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত, ৪১ শতাংশ শিশুর ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু গোসল করতে পারে না, ৩৫ শতাংশ খোলা জায়গায় মলত্যাগ করে, ৫৪ শতাংশ অসুস্থ হলে দেখার কেউ নেই এবং ৭৫ শতাংশ শিশু অসুস্থ হলে ডাক্তারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারে না। একই গবেষণায় বলা হয়, ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ শিশু কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে সর্বোচ্চ ছয় মাস থাকে। এদের মধ্যে ২৯ শতাংশ শিশু স্থান পরিবর্তন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কারণে আর ৩৩ শতাংশ পাহারাদারের কারণে। খোলা আকাশের নিচে ঘুমানোর পরও তাদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ শিশুকে মাসিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা মাস্তানদের দিতে হয়। তারা পুলিশি নির্যাতন এবং গ্রেপ্তারেরও শিকার হয়। জানা যায়, পথশিশুদের বড় একটি অংশ আসে দরিদ্র পরিবার থেকে। দারিদ্র্যই মূল কারণ। মা-বাবার বহু বিবাহও একটি কারণ। তার সঙ্গে যুক্ত হয় নদীভাঙন, ভূমিহীনতা, জলবায়ুর পরিবর্তন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, পথশিশুদের ৮২ শতাংশই নানা ধরনের পেটের অসুখে আক্রান্ত। এই অসুখের পেছনে যে অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ দায়ী, তা বলাই বাহুল্য। ভাসমান এই শিশুদের ৬১ শতাংশই কোনো না কোনো চর্মরোগে আক্রান্ত। পথশিশুদের মধ্যে নানা ধরনের সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার হারও তুলনামূলক বেশি।
আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ, আমাদের সংবিধান, শিশু আইন-১৯৭৪, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইনে শিশুদের প্রতি সব ধরনের নিষ্ঠুরতা, জোর জবরদস্তি, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমাদের শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালের ২২ জুন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘জাতীয় শিশু আইন, ১৯৭৪’ প্রণয়ন করেন। বর্তমান ২০১৮ সালে এই আইন সংশোধিত করেছে বর্তমান সরকার। এই আইনে বঙ্গবন্ধু শিশুর নিরাপত্তা অধিকার নিশ্চিত করার বিধান রেখেছিলেন। আন্তর্জাতিক বিধান অনুযায়ীও সরকার শিশুদের নিরাপত্তা বিধান করতে বাধ্য। বাংলাদেশ ‘ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস (ইউডিএইচআর) মেনে চলে। অনুচ্ছেদ ২২-এ সমাজের প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। আবার অনুচ্ছেদ ২৫-এ সবার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। এসব সামাজিক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত অধিকারের প্রতিফলন আমরা আমাদের সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে দেখতে পাই। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলে স্বাক্ষরকারী দেশ। এই সনদের ১৯ ধারা মতে, শিশুদের যেকোনো ধরনের অনাচারের কবল থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
পথশিশুদের সাহায্য-সহযোগিতার উদ্দেশ্যে রাজধানী জুড়ে গড়ে উঠেছে নানা অসাধু সংগঠন, যারা পথশিশুদের নামে মোটা অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করে থাকে; এসব সংগঠনের উদ্দেশ্য পথশিশুদের সাহায্য করা নয় বরং পথশিশুদের নাম দিয়ে নিজেদের আর্থিক লোভ পূরণ করা। ২০১৭ সালে ‘প্রথম অক্ষর ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠন বিভিন্ন অঞ্চলের পথশিশুদের সহায়তা করার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ তোলা শুরু করে। শুধু রাজধানীতেই দৈনিক ৫০ থেকে ৬০টি বাক্স নিয়ে ৬০০ জন স্বেচ্ছাসেবক দিয়ে লাখ লাখ টাকা তোলা হয় কিন্তু পথশিশুদের জন্য কিছুই করে না ফাউন্ডেশনটি। সাধারণ মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে তোলা অর্থের সামান্য পরিমাণ স্বেচ্ছাসেবকদের দেয়া হতো আর বাকি অর্থ আত্মসাৎ করত ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান। এর পাশাপাশি সংগঠনের আডালে চলত মাদক ব্যবসা। এছাড়া সংগঠনের নারী স্বেচ্ছাসেবকদের নানা প্রলোভনে ধর্ষণ করতেন এবং অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে; যার প্রমাণ ভিডিওর মাধ্যমে রেখে দিতেন। তার সংগঠনের বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ করতে চাইলে নারী স্বেচ্ছাসেবকদের ভয় দেখিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে দেওয়া হবে এবং ছেলে স্বেচ্ছাসেবকদের মাদক দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দিতেন। তাই কেউ চাইলেই মুখ খুলতে পারতেন না। সংগঠনের চেয়ারম্যান মাঝে মধ্যে লোক দেখানোর জন্য কয়েকটি স্থানে পথশিশুদের মাঝে খাবার বিতরণ করতেন এবং লক্ষণীয় বিষয় ছিল খাবারগুলো অধিকাংশ সময় বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও পার্টি সেন্টারের উচ্ছিষ্টাংশ। পত্রপত্রিকা খুললেই এই খবর ভেসে উঠছে চোখের সামনে।
দেশে যেসব ভাসমান শিশু বা পথশিশু তাদের অবস্থান নির্ণয় করে তাদের জন্য সমন্বিতভাবে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি পথশিশুর তালিকা তৈরি করতে হবে এবং তাদের উন্নয়ন, পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা দানের ব্যবস্থা করতে হবে। পথশিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পুষ্টিকর খাদ্য ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা দিতে হবে। এসব শিশুদের সব ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত পথশিশুদের বর্তমান বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে বাস্তব ধারণা অর্জনের লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করতে হবে। পথশিশু, সুবিধাবঞ্চিত এবং অসহায় শিশুদের জন্য পরিচালিত বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করা এখন সময়ের দাবি।
যেসব অসাধু মানুষ পথশিশুদের নাম দিয়ে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য বা ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য অর্থ সংগ্রহ করে সেসব সংগঠনকে আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া উচিত। সেই সঙ্গে যেসব সংগঠন পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে সেসব সংগঠনগুলোর প্রতি কঠোর নজরদারি ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে। এসব প্রতারণা কমিয়ে আনতে হলে সমাজের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও নৈতিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া যেসব সংগঠন পথশিশুদের নিয়ে কাজ করবে সেসব সংগঠনকে সরকারি অনুমোদন দেয়ার ব্যবস্থাও করতে হবে। সামাজিক, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে হবে। পথশিশুদের প্রতি সমাজের সব মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি করতে হবে।
শিশু অধিকার সুরক্ষায় আইন থাকলেও সে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই। কেবল আইনের প্রয়াগ ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি হলেই নিশ্চিত হবে শিশুদের জন্য বাসযোগ্য একটি পরিবেশ। ১৯৯০ সালের শিশু সনদ, ১৯৭৪ সালের আইন ও ২০১৩ সালের শিশু বিল’র সুফল আমরা এখনও পাইনি। তার কারণ, আইনই শেষ কথা নয়, প্রয়োগটা জরুরি। তার চেয়েও বড় কথা যে সমাজে শিশুদের বসবাস সে সমাজ কতটা শিশুবান্ধব। রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই সব শিশুকে সমান সুযোগ-সুবিধার আওতাভভুক্ত করা উচিত। এই শিশুরাই আগামী দিনের সোনার বাংলা গড়বে। পথশিশুদের সামান্যতম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মূলধারায় ফিরিয়ে এনে মানবসম্পদে পরিণত করা যায়। রাষ্ট্রের উচিত সব শিশুর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা এবং সঙ্গে যেসব সংগঠন পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে সেসব সংগঠনকে জবাবদিহির আওতায় আনা।
শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়