আরিফ হোসেন, বরিশাল: দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিদিন কোনো না কোনো স্থানে সড়কে ঝরছে তাজা প্রাণ। আর আহত হচ্ছেন অনেকে, যাদের মধ্যে চিরতরে পঙ্গু হচ্ছেন অর্ধেকেরও বেশি। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে মোট ২৮৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুসহ ২৯৯ জন নিহত হয়েছেন। এতে আরও ৫২০ জন আহত হয়েছেন।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) ও বরিশাল বিআরটিএয়ের বিভাগে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের এক পরিসংখ্যানে এ তথ্য জানা গেছে।
নিসচার পরিসংখ্যান সূত্রে জানা গেছে, বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি হয়েছে বরিশাল জেলায়। ১০৪ সড়ক দুর্ঘটনায় ৯৩ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ২৩৮ জন। তাদের মধ্যে গত বছর সবচেয়ে আলোচিত ও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে গত ৯ সেপ্টেম্বর বিকালে। ওইদিন ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উজিরপুর উপজেলার আঁটিপাড়া এলাকায় মৃত নবজাতকের মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে কাভার্ডভ্যান, অ্যাম্বুলেন্স ও যাত্রীবাহী বাসের ত্রিমুখী সংঘর্ষে নবজাতকের বাবাসহ একই পরিবারের পাঁচ সদস্য ও অ্যাম্বুলেন্স চালকের মৃত্যু হয়।
এছাড়া ঝালকাঠিতে ২০ সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ নিহত ও আহত হয়েছেন ৬০ জন। পিরোজপুরে ২০ সড়ক দুর্ঘটনায় ২২ নিহত ও আহত হয়েছেন ৯ জন। পটুয়াখালীতে ৪২ সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ নিহত ও আহত হয়েছেন ৪৬ জন। বরগুনায় ১৯ সড়ক দুর্ঘটনায় ২২ নিহত ও আহত হয়েছেন ৩১ জন। ভোলায় ৩৯ সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৫ নিহত ও ৭৩ জন আহত হয়েছেন।
তবে নিসচার পরিসংখ্যানের সঙ্গে মিল নেই বিআরটিএয়ের হিসেবের। সরকারি প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, ২০২০ সাল ও চলতি বছর অক্টোবর পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে ৪৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে মাত্র ৫৬ জনের। এর মধ্যে বরিশাল জেলায় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২০ ও আহত হয়েছেন ১৭ জন। এছাড়া চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩৬ ও আহত হয়েছেন ৪৬ জন।
বিআরটিএয়ের জরিপ হয় পুলিশ, সিভিল সার্জন ও মামলার ভিত্তিতে। তাদের নিজস্ব তথ্য সংগ্রহের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ কারণে তাদের হতাহতের সংখ্যা কম আসে বলেও স্বীকার করেছেন বিআরটিএয়ের কর্মকর্তারা। তাদের মতে, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পেশাদার চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে গুরুত্ব পয়েন্টে জনসচেতনতামূলক পোস্টার সাঁটানোসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
ওদিকে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মহাসড়কে থ্রিহুইলার, অটোরিকশা ও অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করায় দুর্ঘটনা বাড়ছে। যদিও সড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে দেশের ২২টি মহাসড়কে ওইসব যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। তবে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে ধীরগতি, অশিক্ষিত ও অদক্ষ চালক, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব আর মানবিকতায় সড়কে তাজা প্রাণ ঝরা রোধ করা যাচ্ছে না বলে মত দেন নিসচা আন্দোলনের নেতারা।
জানা গেছে, সড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ১ আগস্টের ওই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, প্রথম দফায় ২২টি মহাসড়ক নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এর মধ্যে ঢাকা-মাওয়া-কাওড়াকান্দি-ভাঙ্গা-বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়ক ছিল। ঢাকা থেকে পটুয়াখালী পর্যন্ত ৩১৭ কিলোমিটার মহাসড়কে সরকারি নিষেধাজ্ঞা পাত্তা না দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত থ্রিহুইলার ও মোটরচালিত রিকশা চলাচল করছে। ওইসব যানবাহন ছাড়াও মহাসড়কে দূরপাল্লার পরিবহন, ভারী মালবাহী ট্রাক, পিকআপ, লোকাল বাস, মোটরসাইকেল চলাচল করছে। আর দ্রুতগতির প্রতিযোগিতা তো থাকছেই। কখনও কখনও পুলিশের অভিযানে এগুলোর চলাচল সাময়িক বন্ধ থাকলেও অভিযান থেমে গেলে পরিস্থিতি ফিরছে আগের অবস্থায়। ফলে প্রতিদিনই কোনো না কোনো সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন মানুষ।
বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন পিপিএম বলেন, সড়কে থ্রিহুইলার চলাচল বন্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা এড়াতে নিয়মিত উঠান বৈঠক, সচেতনতামূলক প্রচারণা চলমান আছে।
সূত্রমতে, জাতীয় মহাসড়কে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার, আঞ্চলিক মহাসড়কে ৬০ ও জেলা সড়কে ৪০ কিলোমিটার গতিবেগে গাড়ি চালানোর নিয়ম রয়েছে। কিন্তু চালকরা এ নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেন না।
হাইওয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের অংশের যা অবস্থা, তাতে কোনো অবস্থায় ৬০ কিলোমিটার বেশি গতিতে গাড়ি চালানো উচিত নয়। কিন্তু দূরপাল্লার গাড়িগুলো এখানে ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার গতিতে চলে।
জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের এক নেতা বলেন, ব্যবসার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে অনেকে বেশি গতিতে গাড়ি চালায়। প্রতিনিয়ত চালকদের সঙ্গে সভা করে আমরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে নিষেধ করছি। পাশাপাশি সড়কে নছিমন, করিমন, ভটভটি, মাহিন্দ্রা ও ইজিবাইকসহ বিভিন্ন যান চলে। এগুলোর চালকরা দক্ষ নন। এটাও দুর্ঘটনার বড় কারণ বলে মনে করেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক থ্রিহুইলার চালক জানান, লোকাল গণপরিবহনে যাতায়াতে সময় বেশি ব্যয় হওয়ায় যাত্রীরা সিএনজি, আলফা মাহিন্দ্রা ও অটোরিকশা ব্যবহার করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে কয়েকজন চালক বলেন, পেটের তাগিদে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা মহাসড়কে থ্রিহুইলার চালাচ্ছেন।
এদিকে সড়ক দুর্ঘটনার কারন হিসেবে মানুষের সচেতনার অভাবকে দায়ী করেছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. তারেক মাহামুদ আবির। তিনি বলেন, সড়ক আইন যেমন হচ্ছে না মানা, তেমনি সড়কে চলাচলে ডিভাইস সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, দক্ষ চালক নেই বললে চলে। সড়ক দুর্ঘটনাগুলো দক্ষ চালক না থাকার কারণে বেশি হচ্ছে। সরকারের উচিত শিগগির প্রশিক্ষণ দিয়ে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স বুঝিয়ে দেয়া, আর যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই তাদের চালক থেকে অব্যহতি দেয়া। তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসতে পারে বলেন তিনি।
নিসচা কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম আজাদ হোসেন বলেন, অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, জনগণের অসচেতনতা, আইন ও তার যথারীতি প্রয়োগ না থাকার কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব কারণ আর দুর্ঘটনা রোধে নিসচার পক্ষ থেকে বরিশালে জনসচেতনতামূলক পোস্টার সাটানো, জনগণ ও চালকদের মাঝে লিফলেট
বিতরণ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে সভা-সেমিনার করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ বাস্তবায়ন না হওয়াসহ আরও নানা কারণে প্রতিনিয়ত এসব দুর্ঘটনা ঘটছে।
বরিশাল বিআরটিএয়ের বিভাগীয় উপপরিচালক (ইঞ্জিন) মো. জিয়াউর রহমান সড়ক দুর্ঘটনা রোধে তার দপ্তরের নানা উদ্যোগের কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য প্রতিনিয়ত বরিশালের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জনসাধারণ এবং গাড়ির চালক, কন্ডাক্টর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক পথসভা ছাড়াও লিফলেট বিতরণ করার
কথা জানান তিনি।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) এসএম তানভীর আরাফাত বলেন, মহাসড়কে থ্রিহুইলারের চলাচল সম্পূর্ণ অবৈধ। প্রতিনিয়ত এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোসহ আটক করে মামলা দেয়া হচ্ছে। সড়ক পারাপারের ক্ষেত্রে পথচারীরা একটু সচেতন হলে দুর্ঘটনা কমে আসবে। পাশাপাশি চালকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত প্রচার-প্রচারণাও চালানো হচ্ছে বলেন তিনি।