দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠনে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা

মো. আলমামুন: দুর্নীতি হলো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক অবৈধ পন্থায় নীতিবহির্ভূত বা জনস্বার্থবিরোধী কাজ। দুর্নীতি বলতে ব্যক্তিগত স্বার্থ বা লাভের জন্য দায়িত্বের অপব্যবহারকে বোঝায়। সাধারণত ঘুষ, স্বজনপ্রীতি, বলপ্রয়োগ বা ভয় প্রদর্শন, প্রভাব খাটানো এবং ব্যক্তিবিশেষকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে প্রশাসনের ক্ষমতা অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থ অর্জনকে দুর্নীতি বলে। দুর্নীতি এমন একটি কাজ, যেখানে অনৈতিক অর্থ প্রদানের কারণে তৃতীয় কোনো পক্ষ সুবিধা পায়। এতে করে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত পক্ষটি এবং তৃতীয় পক্ষ উভয়ই লাভবান হয়। দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকে পেশা, ক্ষমতা, পদবি, স্বার্থ, নগদ অর্থ, বস্তুসামগ্রী প্রভৃতি। এ অপরাধের দৈহিক শ্রমের চেয়ে ধূর্ত বুদ্ধির প্রয়োজন বেশি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এক জরিপে দেখা যায়, দুর্নীতিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এই হিসাবটি করা হয় ১০০ পয়েন্টের ভিত্তিতে। যে দেশ যত দুর্নীতিমুক্ত সে দেশের পয়েন্ট তত বেশি। হিসাবে দেখা যায়, করোনাকালে দুর্নীতিমুক্ত দেশের তালিকায় প্রথমে রয়েছে ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও সুইডেন। এবছর দুর্নীতিমুক্ত থাকার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হয়েছে নিউজিল্যান্ড। এখানে দুর্নীতি একেবারেই নেই। ৮৮ নম্বর পেয়ে তালিকায় যুগ্মভাবে শীর্ষে রয়েছে নিউজিল্যান্ড ও ডেনমার্ক। ৮৫ নম্বর পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ফিনল্যান্ড। অন্যদিকে দুর্নীতিপরায়ণ দেশের তালিকায় রয়েছে ভেনেজুয়েলা, ইয়েমেন, সিরিয়া, সোমালিয়া ও দক্ষিণ সুদান। এ দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হলো দক্ষিণ সুদান ও সোমালিয়া। এই দুই দেশের প্রাপ্ত নম্বর ১২। ১৮০ দেশের তালিকায় এমন ২৬টি দেশ রয়েছে, যাদের পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রথম অবস্থানে রয়েছে গ্রিস। আগের অবস্থান থেকে ১৪ ধাপ এগিয়ে এসেছে দেশটি। মিয়ানমার ১৩ ধাপ এগিয়েছে এবং সাত ধাপ এগিয়েছে ইকুয়েডর। অন্যদিকে অবনতি ঘটেছে ২২টি দেশের।

বাংলাদেশ একটি অন্যতম দুর্নীতিপরায়ণ দেশ। বাংলাদেশের দুর্নীতি এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা একটা সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের এমন কোনো খাত নেই যা দুর্নীতি দ্বারা আক্রান্ত হয়নি। দেশে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। বিগত বছরগুলোয় দেখা যায়, বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিপরায়ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, ২০২০’-এর রিপোর্টে জানানো হয়, দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ নিচে নেমে এসেছে। রিপোর্টে আরও বলা হয়, ১৮০টি দেশের তালিকায় নিচের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। ২০১৯ সালে নি¤œক্রম অনুযায়ী এ অবস্থান ছিল ১৪তম। দুর্নীতি বৃদ্ধির জন্য কভিড মহামারির মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক দুর্নীতিকে অন্যতম কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। দুর্নীতির এমন ভয়াবহ অবস্থা দেশের অবকাঠামোকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। বাংলাদেশের যেসব ক্ষেত্রে দুর্নীতি অধিক হারে ঘটে থাকে, সেগুলো হলোÑরাজনৈতিক; প্রশাসনিক; সেবা খাত: স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা, পুলিশ সেবা, বিচার, শিক্ষা; অর্থনৈতিক ক্ষেত্র: উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, শুল্ক, কর ও ভ্যাট, বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন; বেসরকারি ও অন্যান্য ক্ষেত্র।

বাংলাদেশে দুর্নীতির কারণ বহুবিধ। মূলত লোভ ও উচ্চাভিলাষী মনোভাব ব্যক্তিকে দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে। অনেক চাকরিজীবী দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অতিরিক্ত আয়ের চেষ্টা করে। তারা ফাইলের কাজের বিনিময়ে ঘুষ, বকশিশ, কমিশন, চা-নাস্তা বাবদ খরচ, দ্রব্যসামগ্রী প্রভৃতি আদায় করে থাকে। কখনও এই দুর্নীতিবাজরা দাপ্তরিক ফাইল আটকিয়ে ঘুষ গ্রহণ করে। আবার অনেক সময় অফিসের প্রধান কর্তার টেবিলে দীর্ঘদিন নানা কারণে ফাইলবন্দি হওয়ার জন্য অধস্তন কর্মচারীরা এ সুযোগ গ্রহণ করে। অফিসের প্রধান ও শাখাপ্রধান দুর্নীতিবাজ হলে এর প্রভাব সংশ্লিষ্ট সব শাখায় সংক্রমিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিলাসী জীবন বা উচ্চাকাক্সক্ষার নেশা এবং স্বল্প সময়ে অধিক সম্পদের মালিক হওয়ার প্রত্যাশা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্নীতিবাজে পরিণত করে। তাদের বৈধ উপার্জনের সঙ্গে জীবনযাত্রার মানের মিল থাকে না। এসব পরিবারের সদস্যদের চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধে দুর্নীতি মিশে থাকে। পরবর্তী জীবনে তারাও দুর্নীতিবাজে পরিণত হয়। তাদের অনেকের চাকরিজীবন শুরু হয় অন্য এক দুর্নীতিবাজের মাধ্যমে। পরিবারের সদস্যদের অধিক চাহিদাও অনেক সময় উপার্জনকারীকে দুর্নীতি করতে বাধ্য করে।

দেশে একদিকে কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা এবং অন্যদিকে ব্যাপক বেকারত্বÑএ পরিস্থিতিতে যুবসমাজ যে কোনো চাকরির প্রত্যাশায় বিপুল পরিমাণ অর্থ ঘুষ দিতে বাধ্য হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, সমাজব্যবস্থায় যাদের অর্থ-সম্পদ বেশি, তারাই মর্যাদার মাপকাঠিতে উঁচু স্তরের বলে অনেকের ধারণা। তাই মর্যাদা ও প্রতিপত্তি লাভে ধন-সম্পদ সংগ্রহ ও অধিক ধনী হওয়ার আশায় অনেকে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়।

রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার অভাব, অগণতান্ত্রিক পন্থায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার তীব্র আকাক্সক্ষা দুর্নীতি বিস্তারে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। রাজনীতিতে দেশপ্রেমিক, যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্বের অভাবও দুর্নীতির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক। দুর্নীতিবাজদের কোনো মানবিকতা ও দেশপ্রেম থাকে না। অনেক সময় দেখা যায়, দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব সমাজজীবনকে অস্থির করে তোলে। এ সামাজিক অস্থিরতাই আবার দুর্নীতির জন্ম দেয়।

সাধারণত দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণে অনেক সময় ব্যবসায়ী, আড়তদার, মজুতদার, মুনাফাখোর, মধ্যস্বত্বভোগী ও ফটকা কারবারিরা দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলে। তারা প্রতারণা ও দুর্নীতির মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জন করে। এর ফলে স্বল্প আয়ের লোকেরা অর্থকষ্টের কারণে বাঁচার তাগিদে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। দুর্নীতি প্রতিরোধে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান যখন দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যার্থ হয়, কিংবা এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, তখন সমাজ ব্যাপকভাবে দুর্নীতিতে ছেয়ে যায়।

সমাজজীবনে দুর্নীতির ক্ষতিকর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। যে সমাজ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, সে সমাজে একে অন্যের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে। ন্যায্য অধিকারের বঞ্চনা দুর্নীতিপ্রবণ সমাজের চিত্র। চাকরিজীবনে স্বজনপ্রীতি বা ঘুষের বিনিময়ে যদি অযোগ্যরা নিয়োগ ও পদোন্নতি পায়, তাহলে সমাজের যোগ্যরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। দুর্নীতির কারণে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হয় এবং মানুষের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে, ফলে যোগ্যদের প্রতিভা বিকশিত হয় না। সৃজনশীলতা ক্রমেই হ্রাস পায়। দুর্নীতিপ্রবণ সমাজে আইনশৃঙ্খলা, নিয়ম-কানুন প্রভৃতির প্রতি মানুষ শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। দুর্নীতি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে দায়িত্ব-কর্তব্যে অনীহা এবং সম্পদের অপব্যবহার করার মানসিকতা সৃষ্টি করে। সততা, আদর্শ ও মূল্যবোধ লোপ পেতে থাকে। সামগ্রিকভাবে দুর্নীতি জাতীয় বিপর্যয়ের মূল কারণ। এটি দেশের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির প্রতিবন্ধক।

বাংলাদেশের দুর্নীতির শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত, এক দিনে তা উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়। দুর্নীতিকে দমন করতে হলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করতে হবে এবং এর ক্ষমতা ও কার্যবিধি বিস্তৃত করার পাশাপাশি সরকার ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে দুদক ও এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুক্ত রাখতে হবে। দলমত নির্বিশেষে দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আইনের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের কঠোর শাস্তি প্রদান করে দুর্নীতি সম্পর্কে জনমনে ভীতির সঞ্চার এবং নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে দুর্নীতিবাজদের বয়কট করতে হবে। কোনো দলে যাতে দুর্নীতিবাজরা প্রবেশ করতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দুর্নীতি দমন কার্যক্রম যাতে কোনো বিশেষ মহলের চাপে বন্ধ বা ভিন্ন পথে পরিচালিত না হয়, সেদিকে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। ঘুষ দেয়া ও নেয়া সম পরিমাণ অপরাধ। আইন ও সমাজের দৃষ্টিতে উভয়কে দুর্নীতিবাজ হিসেবে গণ্য করে শাস্তি প্রদান করতে হবে। দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সরকারের সব কাজে জনগণের সম্পৃক্ততার লক্ষ্যে জবাবদিহিমূলক কার্যক্রম চালু করতে হবে। বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে।

সর্বোপরি, দুর্নীতি থেকে এ দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে হলে সর্বত্র প্রয়োজন সততার একটি আবহ, দরকার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির পরিমণ্ডল। একথা সবার স্মরণ রাখা দরকার‘এ দেশটি আমার, আপনার, আমাদের সবার।’ ১৯৭১ সালে এক সাগর রক্ত ও লাখো মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এ দেশটির জন্ম হয়েছিল। স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল পেতে হলে দেশ থেকে দুর্নীতি নামক এই কালো, ভয়ংকর ও সর্বগ্রাসী ব্যাধিকে যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করতে হবে।

তাই আসুন, সবাই সম্মিলিত কণ্ঠে দুর্নীতিকে ‘না’ বলি, দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করি এবং তাদের কঠোর হস্তে দমন করি। নিজ নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা করি বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে তুলে ধরতে। দুর্নীতি প্রতিরোধে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ ও দুর্নীতি প্রতিরোধকল্পে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব হলে অতি অল্প সময়ে আমাদের সবার প্রিয় বাংলাদেশকে একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

শিক্ষার্থী

সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০