বদ্বীপ পরিকল্পনায় ভূমি ব্যবস্থাপনা

ইমদাদ ইসলাম: বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সাফল্যের সঙ্গে সহস্রাব্দ উন্নয়ন  লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) দারিদ্র্য নিরসন, বিশ্বের সুরক্ষা এবং সবার জন্য শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণের সর্বজনীন আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নেয়ার জন্য সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার দেয়া হয়েছে। বর্তমান সরকারের দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নের চাকা নিখুঁতভাবে এগিয়ে চলছে। উন্নয়নের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এখন আমাদের এ প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ২০৪১-এর মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার উদ্দেশ্য পরিকল্পনা গ্রহণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনে অভিঘাত সহিষ্ণু সমৃদ্ধ বদ্বীপ গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ‘বাংলাদেশ ডেলটা প্ল্যান ২১০০’-এর মাধ্যমে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। প্রাপ্ত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রার মান দ্রুত উন্নয়ন করে উন্নত বাংলাদেশ গঠন করাই এসব পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে নি¤œ-মধ্যআয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার সারাদেশে সুষম উন্নয়ন করে যাচ্ছে, বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে সড়ক, রেল, নৌ, বিমানসহ সমগ্র যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন আমাদের চারপাশে ইতোমধ্যে দৃশ্যমান।

পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পরিচিতি রয়েছে। নদীসহ ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটারের এদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১ হাজার ২০০ লোক বসবাস করে। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ উন্নয়নের কাক্সিক্ষত দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনে  প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দেয়। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করার উদ্দেশ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিবর্তন  এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তথ্য ও অগ্রাধিকারের  পরিবর্তনগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে নেদারল্যান্ডস ও স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ পরিকল্পনায় বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সমুদ্র ও নদী থেকে অবস্থানগত দূরত্বের কারণে গাজীপুর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, ময়মনসিংহ, নীলফামারী এবং শেরপুর এই ছয়টি জেলা তুলনামূলকভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ তাই এ জেলাগুলোকে অপেক্ষাকৃত কম দুর্যোগপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির ওপর ভিত্তি করে জেলাগুলোকে ছয়টি হটস্পটে ভাগ করা হয়েছে। মোট ১৯টি জেলা নিয়ে উপকূলীয় অঞ্চল, যার মোট আয়তন ২৭ হাজার ৭৩৮ বর্গকিলোমিটার। এ জেলাগুলো হলো বাগেরহাট, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, গোপালগঞ্জ, যশোর, ঝালকাঠি, খুলনা, লক্ষ্মীপুর, নড়াইল, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা ও শরীয়তপুর। মোট ১৮টি জেলা নিয়ে বরেন্দ্র এবং খরাপ্রবণ অঞ্চল, যার আয়তন ২২ হাজার ৮৪৮ বর্গকিলোমিটার। এ জেলাগুলো হলো বগুড়া, চুয়াডাঙ্গা, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, নওগাঁ, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নীলফামারী, পাবনা, পঞ্চগড়, রাজশাহী, রংপুর, সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ ও সিলেট।

মোট ৭টি জেলা নিয়ে হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল, যার আয়তন ১৬ হাজার ৫৭৪ বর্গকিলোমিটার। জেলাগুলো হলো ব্রাক্ষণবাড়ীয়া, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ  ও সিলেট। মোট ৯৩টি জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, যার আয়তন ১৩ হাজার ২৯৫ বর্গকিলোমিটার। জেলাগুলো হলো বান্দরবান, খাগড়াছড়ি এবং রাঙামাটি। মোট ২৯টি জেলা নিয়ে গঠিত নদী অঞ্চল এবং মোহনা, যার মোট আয়তন ৩৫ হাজার ২০৪ বর্গকিলোমিটার। জেলাগুলো হলোÑবরগুনা, বরিশাল, ভোলা, বগুড়া, চাঁদপুর, কুমিল্লা, ফরিদপুর, ফেনী, গাইবান্ধা, গোপালগঞ্জ, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, লালমনিরহাট, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নোয়াখালী, পাবনা, পটুয়াখালী, রাজশাহী, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল এবং খুলনা। মোট ৭টি জেলা নিয়ে নগর এলাকাগুলো গঠিত, যার আয়তন ১৯ হাজার ৮২৩ বর্গকিলোমিটার। জেলাগুলো হলোÑবরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর ও সিলেট। এখানে উল্লেখ, হাইড্রোলজিক্যাল কারণে একাধিক জেলা একাধিক হটস্পটের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের মাটি ও পানির সংমিশ্রণ এদেশকে একটি উর্বর ভূখণ্ডে পরিণত করেছে। প্রাকৃতিক এই আশীর্বাদের কারণে এদেশের অধিকাংশ জমিতে বছরে দুই বা ততোধিক ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। শুধু তাই না আধুনিক সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পাচ্ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি রপ্তানি সম্ভাবনাও  তৈরি হয়েছে। বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ ভূমিব্যবস্থাপনাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনায় কৃষি, বন, নদীনালা, খাল, বিলসহ নগর ও শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জমি সবই এ পরিকল্পনার আওতায় আনা হয়েছে। কৃষি ও অকৃষি উভয় খাতের ব্যবহƒত জমিকে এক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়েছে। পরিপ্রেক্ষিতে  যেসব কৌশল এ পরিকল্পনায় গ্রহণ করা হয়েছে তা হলো, ড্রেজিং থেকে প্রাপ্ত মাটি/ বালিব্যবস্থাপনা বিষয়েও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন, টেকসই খাদ্যশস্য উৎপাদনে বন্যা বা নদী ভাঙন থেকে কৃষিজমি সংরক্ষণ। লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ এবং মরুকরণ প্রতিরোধ, মেঘনা মোহনায় নতুন জেগে ওঠা ভূমির ব্যবস্থাপনা, কৃষি ও অকৃষিজমি বৃদ্ধির জন্য টেকসই উপকূলীয় ভূমিব্যবস্থাপনা, নগরায়ণের জন্য স্থানীয় ভূমি ব্যবহারের পরিকল্পনা। ভূমি স্থিতিশীল করার জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে বনায়ন বৃদ্ধি, ভূমি রক্ষায় উপকূলীয় পানিসম্পদ অবকাঠামোগুলোর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, মাটির গুণাগুণ বজায় রাখা এবং ভূমির ক্ষয়ক্ষতি রোধ করা, ল্যান্ড জোনিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আইন ও বিধি প্রণয়ন করা।

বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনা সময়ে সময়ে প্রয়োজনে হালনাগাদ করাসহ নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তির সমাবেশ ঘটানোর প্রয়োজন হবে। বিশ্বের অন্যান্য বদ্বীপ পরিকল্পনার অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশ ও বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিহার করে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। ডেল্টা-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশেরও দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। রূপকল্প ২০২১-এর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনের আলোকে স্বপ্নের উন্নয়ন পথে জাতিকে এগিয়ে নেবে ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০।’ পিআইডি নিবন্ধন

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০