মো. আতিকুর রহমান: আমাদের সমাজে বাথরুম সিঙ্গার কথাটি বেশ জনপ্রিয়। কারণ হেঁড়েগলার গায়কদের কাছে গলা সাধার একমাত্র স্থানই হলো বাথরুম। সংসারজীবনের অশান্তি থেকে বাঁচার ক্ষেত্রেও বাথরুমের নাকি রয়েছে অনন্য ভূমিকা। কবির ভাষায়Ñ‘বাছা অশান্তির দাবানল বহে যখন ভূমে, শান্তি পেতে যাও বাথরুমে।’ বাথরুমের উপকারিতা এখানেই শেষ নয়। বলা হয়ে থাকে, আর্কিমেডিস তার বিখ্যাত সূত্রটি বাথরুমে বসেই আবিষ্কার করেন। বোদ্ধা মহলের ধারণা নিউটনের মধ্যাকর্ষণ সূত্র আবিষ্কারের পেছনেও নাকি ছিল বাথরুম।
এ তো গেল ভিন্ন রকমের বাথরুম সমাচার। আধুনিক নগর অবকাঠামো উন্নয়নে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের কথা বিবেচনায় পাবলিক টয়লেট অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত। এক্ষেত্রে জাপান সরকার এর গুরুত্বটা বিশ্ববাসীর কাছে আরও বেশি স্পষ্ট করেছে। জাপানে গঠন করা হয়েছে টয়লেট মন্ত্রণালয়। টয়লেটের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে প্রতি বছর ১৯ নভেম্বর পালন করা হয় বিশ্ব টয়লেট দিবস। এ বছর valuing toilets স্লোগানকে সামনে রখে পালিত হচ্ছে বিশ্ব টয়লেট দিবস।
ঢাকা শহরের জনসংখ্যা প্রায় দুই কোটি। সময়ের পরিক্রমায় জনসংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে নাগরিক সমস্যার পরিধি। নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ করা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই নাগরিক সেবা থেকে যাচ্ছে অধরা। এমন অধরা নাগরিক সেবাগুলোর মধ্যে একটি হলো পাবলিক টয়লেট।
সকাল থেকে রাত অবধি ঢাকা শহরে ফুটপাত, রাস্তাঘাট, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, বিমানবন্দর, লঞ্চঘাট ও বাজারে মানুষ গিজগিজ করে। আমাদের হাতেগোনা যে কয়টি গণপরিসর আছে, সেখানেও মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে। এ শহরে লক্ষাধিক হকার রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য ও অন্য জিনিসপত্র সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি বিক্রি করে। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর জন্য নেই পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট। যেগুলো রয়েছে সেগুলোর অবস্থাও খুব তেমন ভালো নয়। ফলে কিডনিজনিত রোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী। বিশেষ করে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শৌচাগার ব্যবহারে আলাদা ব্যবস্থা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নেই, যে কারণে ঢাকা শহরে অধিকাংশ নারী কম পানি পান করেন। ফলে তারা পানিস্বল্পতাজনিত বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন। এছাড়া গরিব মানুষ, বিশেষ করে বস্তিবাসী, হকার, রিকশাচালক, ভিক্ষুক ও ভাসমান মানুষ, যারা বেশিরভাগ সময় বাইরে অবস্থান করেন, তাদের শৌচাগার ব্যবহারের কোনো ব্যবস্থাই নেই। ফলে বাধ্য হয়ে তারা ফুটপাতের পাশে, পার্কে, লেকে ও সড়কের পাশে বিভিন্ন উš§ুক্ত জায়গায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। এর ফলে একদিকে শহরের পরিবেশ যেমন দূষিত হচ্ছে, অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
বর্তমানে দুই সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে বিভিন্ন স্থানে এবং গণপরিসরগুলোয় আধুনিক পাবলিক টয়লেট তৈরি করা হচ্ছে, যা সত্যিই প্রশংসনীয়। কিন্তু পাবলিক টয়লেট যতটুকু আগ্রহ ও মনোযোগ দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে, ব্যবস্থাপনায় সে আগ্রহ ও মনোযোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গণপরিসরগুলোয় যে টয়লেটগুলো নির্মাণ করা হয়েছে, তা দিন-রাতের বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে। অপরদিকে রাস্তার পাশে নির্মিত টয়লেটগুলোকে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব আদায়ের উৎস হিসেবে বিবেচনা করায় এর পরবর্তী ব্যবস্থাপনায় তেমন কোনো মনোযোগ দেয় না। ফলে নির্মিত পাবলিক টয়লেটগুলো হয়ে পড়ে ব্যক্তিবিশেষের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে।
পাবলিক টয়লেটকে নগরবাসীর সেবা দেয়ার অবকাঠামো হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বসহ বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন; যেমন টয়লেট ব্যবহারকারী সংখ্যা বৃদ্ধিকল্পে টয়লেট নির্মাণে সহজে দৃশ্যমান স্থান নির্বাচন করা এবং নারী, পুরুষ, শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব পৃথক অবকাঠামো রাখা, টয়লেট ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা এবং ব্যক্তিগত সম্মানের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা এবং টয়লেট নির্মাণ ও সরঞ্জাম ব্যবহারে দীর্ঘ মেয়াদে রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়, তেমন উপকরণ ব্যবহার করা। শুধু ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে অর্থমূল্য নিয়ে পরিচালনার চিন্তা থেকে বের হয়ে এসে অন্য উৎস থেকে আয় করার সুযোগ তৈরি করা দরকার। যেমন টয়লেটের দেয়ালে বিজ্ঞাপন বা একটি অংশে এটিএম বুথ ভাড়া দেয়া যেতে পারে। ছিন্নমূল হতদরিদ্র মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে বিনা মূল্যে টয়লেট সেবা নিশ্চিত করতে বিশেষ কার্ডের ব্যবস্থা করতে হবে।
নির্মাণ-পরবর্তী ব্যবস্থাপনার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে; বিশেষ করে দক্ষ নারী ও পুরুষকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে নিয়োগ করা এবং তাদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। টয়লেট ব্যবহারকারীদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক উপকরণ, যেমন টয়লেট টিস্যু, হাত ধোয়ার সাবান, স্যানিটারি ন্যাপকিন, সার্বক্ষণিক পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পাবলিক টয়লেট মানসম্মত না হলে সহজে অভিযোগ প্রদানের ব্যবস্থা ও প্রয়োজনে দোষীদের শাস্তি ও জরিমানা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সর্বোপরি সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঢাকা শহরের জনসংখ্যার অনুপাতে প্রায় তিন হাজার পাবলিক টয়লেটের প্রয়োজন। সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে এতগুলো টয়লেট নির্মাণ যেমন সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি এত জায়গাও নেই। এজন্য সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও দায়দায়িত্ব নিতে হবে। রাস্তার পাশে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সহজে প্রবেশযোগ্য স্থানে নিজ দায়িত্ব, ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নে পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করার নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। পেট্রল পাম্প ও সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোয় আধুনিক পাবলিক টয়লেট নির্মাণের বাধ্যবাধকতা আনয়ন করতে হবে।
স্যানিটেশন বিষয়ে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বে সর্বজনবিদিত। ১৯৯০ সালেও দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৪ শতাংশ মানুষ খোলা জায়গায় মলত্যাগে অভ্যস্ত ছিল, বর্তমানে যা এক শতাংশেরও নিচে। এ সাফল্য ধরে রাখতে হলে পাবলিক টয়লেটের কোনো বিকল্প নেই। নগরবাসীর স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও শহরের মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট গড়ে তোলার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৬ নম্বর লক্ষ্যপূরণে নগর অবকাঠামো উন্নয়নে পাবলিক টয়লেটকে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে।
মুক্ত লেখক
onatiq88@yahoo.com