আসিফ হোসেন: পরিবর্তন থেকেই জন্ম নিয়েছে আজকের এই অত্যাধুনিক বিশ্ব। দুই যুগ আগের সময়ের সঙ্গে বর্তমানকে তুলনা করলে বিজ্ঞান ও আধুনিকতার চরম বিপ্লবকে উপলব্ধি করা একদমই কষ্টসাধ্য নয়। এসব পরিবর্তন আমাদের কাজকে সহজ ও সাশ্রয়ী করছে এবং সময়ক্ষেপণও কমাচ্ছে; আবার একই সঙ্গে সৃষ্টি করছে অনেক দুরূহ সমস্যারও। আধুনিকতার স্পর্শে উন্নত হচ্ছে পুরো দুনিয়া; আবার এটাই কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের জন্য। একদিকে মানুষের মহামূল্যবান সময় রক্ষা পাচ্ছে। অন্যদিকে কিছু আবিষ্কার আমাদের ব্যস্ত করেছে মূল্যহীন সব কাজে। জীবনরক্ষাকারী সব খোঁজ আজ প্রাণহরণকারী আয়োজনে পরিণত হচ্ছে। অভূতপূর্ব আবিষ্কারের দ্বারা তৈরি হচ্ছে আকাশচুম্বী স্থাপনা। আবার এরই মাধ্যমে ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের আঙিনা। প্রতিটি মুদ্রার ভিন্ন দুই পৃষ্ঠের মতো প্রতিটি বিষয়েরও থাকে ভিন্ন চেহারা। বিজ্ঞান ও আধুনিকতার বিশাল বিপ্লবের আড়ালেও বিশ্ব ও মানবজাতি সম্মুখীন হচ্ছে অপূরণীয় সব ক্ষয়-ক্ষতির। বিজ্ঞানের হাত ধরে বহু সমস্যার সমাধান আসছে, সেইসঙ্গে আসছে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যা দিন দিন রূপ নিচ্ছে বৃহৎ থেকে বৃহত্তর পর্যায়ে এবং বিশেষজ্ঞদের কপালে টানছে চিন্তার রেখা।
ঘোড়ার গাড়িকে সরিয়ে তার স্থান করে নিয়েছে মোটরযান। ডাক বিভাগকে অবসর দিচ্ছে ইমেইল। এখন আর অন্ধকারে রাত অতিবাহিত করার প্রয়োজন নেই। গ্রীষ্মের মৌসুমে হাতপাখার ব্যবসাও বিলুপ্তপ্রায়। কুঁড়েঘরগুলোর আর তেমন দেখা মেলে না, গড়ে উঠছে বিশাল বিশাল স্থাপনা। আকাশের দিকে তাকালেই বিমান ও হিলিকপ্টারের অবাধ বিচরণ দেখা যায়। এসব তো রোগের প্রতিষেধক। তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো কী!
মানবসভ্যতার পথে যত বাধা ও সমস্যা এসেছে, মানুষই তার সমাধান করেছে। তবে প্রতিটা সমাধানই যেন জš§ দিচ্ছে আরও জটিল কিছু। আলফ্রেড নোবেল ডিনামাইট তৈরি করেছিলেন পাহাড় ও অনাকাক্সিক্ষত স্থাপনা ধ্বংস করে মানুষের নির্মাণকাজকে প্রগতিশীল করার উদ্দেশ্যে। এর পেছনে যতই মহান উদ্দেশ্যই থাকুক না কেন, বর্তমানে মানুষ হত্যায় বহুল ব্যবহƒত অস্ত্র কিন্তু এটিই। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, আরডিএক্স, টিএনটি, এইচএমএক্স প্রতিটি বিস্ফোরক পদার্থের আবিষ্কারের ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা ডিনামাইটের অনুরূপ। দেশে দেশে সহিংসতা ও আতঙ্ক সৃষ্টিতে সুপরিচিত। আগে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে পাড়ি দিতে হতো নদী, পাহাড় ও সমুদ্র। কয়েক মাসের যাত্রাশেষে ক্লান্ত শরীর পৌঁছাত গন্তব্যে। আবার কিছু ক্ষেত্রে মৃত শরীর। এত ভোগান্তি ও জটিলতার প্রতিষেধক হয়ে এলো মোটরযান, রেল, নৌযান ও আকাশযান। একইভাবে আদিকাল ও আধুনিক যুগের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য সৃষ্টি করেছে বিদ্যুৎ। বিজ্ঞানের আজ পর্যন্ত সবচেয়ে মূল্যবান আবিষ্কার হিসাবে বিদ্যুৎকে চিহ্নিত করলে ভুল হবে না। বিদ্যুতের উপস্থিতি ব্যতীত আধুনিক বিজ্ঞানকে কল্পনা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বিদ্যুতের গুরুত্ব যেমন সীমাহীন, এর ক্ষতিকর দিকগুলো তেমনই অপূরণীয়। এগুলোর প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক হলেও এর বিরূপ প্রভাবকে অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় নেই।
বিশ্ববাসীর জন্য সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হলো বৈশ্বিক উষ্ণতা। যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ার সিংহভাগই কার্বন মনো-অক্সাইড গ্যাস। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও শিল্প-কলকারখানাগুলোর ধোঁয়া থেকে বস্তুকণা, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সিসাসহ অন্যান্য ক্ষতিকর বহু উপাদান বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। এগুলো একদিকে দূষিত করছে বায়ু, অপরদিকে বাড়িয়ে চলছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। এর ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রতীরবর্তী বহু নিচু এলাকা। লবণাক্ত হয়ে পড়ছে লাখ লাখ হেক্টর কৃষিজমি। সেইসঙ্গে উল্লেখযোগ্যহারে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও।
সাধারণ মানুষের কাছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহƒত এক প্রযুক্তি। এগুলো শুধু যোগাযোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; যোগাযোগ ও বিনোদনের গণ্ডি পেরিয়ে এগুলো পৌঁছে গেছে অপসংস্কৃতি ও অপপ্রচারের দ্বারে। মানুষের প্রয়োজন থেকে আসক্তিতে রূপ নিচ্ছে। টেলিভিশন ও ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মও অসুস্থ বিনোদনের জনপ্রিয় মাধ্যম। তরুণ সমাজের মাঝে ডিভাইসকেন্দ্রিক হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে নিছক ভার্চুয়াল জগতে। সোশ্যাল মিডিয়া যেমন সচেতন করছে সমাজকে, তেমনই সমাজ ও গোষ্ঠী সহজেই গোমড়া হচ্ছে বিভিন্ন গুজবে বিশ্বাস করে। এসব হুজুগে বিশ্বাস প্রায়ই সহিংসতা ও হানাহানিতে রূপ ধারণ করে। সম্প্রতি কুমিল্লার মন্দিরে পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননার বিভ্রান্তিকর খবর পেয়ে দেশজুড়ে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ ও হামলা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি সবারই জানা।
আগের মতো এখন আর খেলার মাঠ নেই। মাঠ থাকলেও খেলোয়াড় নেই; নেই শিশুদের মধ্যে দুরন্তপনা। রাতের লোডশেডিংয়ে দেখা যায় না কানামাছি খেলা। মেয়েদের পুতুলখেলা বা ছেলেদের ডাঙ্গুলি। কুতকুত, কাবাডি, নুনতা খেলা আর কত কী! যেগুলো শিশুদের দৈনিক কাজের তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল, এখন সেগুলোর নামও বর্তমান প্রজšে§র কাছে অজানা। আধুনিক ডিভাইস ও গেমসের কবলে তাদের চঞ্চলতা মৃতপ্রায়। সামাজিক ও মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের মাঝে প্রবেশ করছে কর্মবিমুখতা। মানুষের আবিষ্কার আজ মানুষকে অমানুষে পরিণত করছে; মানুষ পরিণত হচ্ছে হƒদয়বিহীন যন্ত্রে। মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্বের প্রথম জৈবিক চাহিদার স্তর পূরণ করে ছুটছি খ্যাতি ও ব্যাংক-ব্যালেন্স বৃদ্ধিতে। মানুষের কাছ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে ব্যস্ত হয়ে উঠছি নিষ্প্রাণ কাগজ ও যন্ত্রের সঙ্গে। আপনজনদের কাছ থেকে ক্রমেই বাড়ছে দুরত্ব। ব্যস্ততার জালে ভুলে যাচ্ছি বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য। প্রবীণ বয়সে সঙ্গী তাদের একাকিত্ব। বাবা-মায়ের কাছে সন্তান অমূল্য, তবে সন্তানের কাছে বাবা-মা আজ মূল্যহীন এক বোঝামাত্র।
বিকৃত আধুনিকতার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বলা যায় পারমাণবিক অস্ত্রকে। বিস্ময়কর এ আবিষ্কারের জনহিতকর কোনো কাজেই তার ব্যবহার নেই। আছে শুধু ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর এক বিশাল ক্ষমতা। ছোট আকারের একটি পারমাণবিক বোমা গোটা একটি শহরকে মুহূর্তে বিলীন করে দিতে পারে। শুধু আতঙ্ক ও ক্ষমতার মশাল জ্বালিয়ে রাখতে বেশ কিছু দেশ মেতে উঠেছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও ব্যবহারে। পৃথিবী সাক্ষী হিরোশিমা-নাগাসাকির ভয়ংকর ইতিহাসের।
বিজ্ঞানকে ব্যবহার করা হোক এখন পর্যন্ত সংঘটিত বিজ্ঞানের বিরূপ প্রভাব থেকে বিশ্বকে মুক্ত করার জন্য। উজার করা বনভূমির বিকল্প কিছু আবিষ্কার করা হোক। ওজোন স্তরের ছিদ্র বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়া হোক। নতুন আবিষ্কৃত কিছুকে স্বীকৃতি দেয়ার আগে এর সম্ভাব্য সব ক্ষতিকর দিক পূর্বানুমান ও মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। ক্ষতিকর প্রযুক্তি পরিহার করতে হবে। সেইসঙ্গে এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করে বাজারজাত করা আবশ্যক।
শিক্ষার্থী
ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়