ক্রিকেট স্পনসর ও নির্লজ্জ বিজ্ঞাপন

কাজী সালমা সুলতানা: তখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ফ্রেম ওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল বা এফসিটিসি গ্রহণ করেনি। সে সময়ে ব্রিটেন সিদ্ধান্ত নেয় সে দেশের রেলগাড়িতে কোনো সিগারেটের বিজ্ঞাপন প্রচার করবে না। এ বিষয়ে আদেশ জারির পর এগিয়ে আসে আব্দুল্লাহ নামক সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। তারা ব্রিটেন সরকারের কাছে প্রস্তাব করে, সেদেশের রেলগাড়িতে ধূমপানের স্বাস্থ্যঝুঁকিমূলক সতর্কতাপূর্ণ বিজ্ঞাপন প্রচার করতে চায়। ব্রিটেন সরকার তাদের প্রস্তাবে সম্মতি দেয়। পরে দেখা গেল, প্রতিটি কামড়া এবং দৃষ্টিগোচর হয় রেলগাড়ির এমন সব স্থানে সতর্কতামূলক বিজ্ঞাপন লেখা হয়েছে। বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছে, , Smoking is injurious to health, even Abdulla.’ আব্দুল্লাহ বিশ্বের অন্যতম দামি সিগারেট। ধূমপানের স্বাস্থ্যহানিকর এই সতর্কতামূলক বিজ্ঞাপনের আড়ালে আব্দুল্লাহ কোম্পানি তাদের সিগারেটের বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে। বিষয়টি অনেক পরে বুঝতে পারে সেদেশের সরকার। বিজ্ঞাপনের ভাষায় তারা বুঝিয়ে দিয়েছে যে, আব্দুল্লাহ সবচেয়ে ভালো সিগারেট।

একসময় ক্রিকেট ম্যাচগুলোর পুরো কর্তৃত্ব ছিল বিশ্বের বৃহত্তম সিগারেট উৎপাদনকারী ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। তারা বেনসন অ্যান্ড হেজেজ ব্র্যান্ডের স্পন্সর বা সৌজন্য দিত ক্রিকেট ম্যাচগুলোয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৫ সালে এফসিটিসি গ্রহণের পর সিগারেট বা তামাকের প্রকাশ্য বিজ্ঞাপন প্রচারের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এরপর ক্রিকেট ম্যাচ থেকে বেনসন অ্যান্ড হেজেজের বিদায় হয়। বাংলাদেশসহ এ পর্যন্ত বিশ্বের ১৬৮টি দেশ এফসিটিসি’তে স্বাক্ষর করেছে। তার পর থেকে কোনো খেলার স্পন্সর করতে পারে না সিগারেট বা তামাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশ্বের অনেক দেশেই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে তামাক নিয়ন্ত্রণকে আইনি কাঠামোয় আনা হয়েছে। বাংলাদেশেও তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয়েছে।

তামাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করত ক্রিকেট বা খেলাধুলার স্পনসরে। এই স্পনসরের নামে তারা ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রভূত ভূমিকা পালন করছিল বলে তখন বলা হতো। তা কি আসলে ক্রীড়াক্ষেত্রের উন্নয়নে ভূমিকা পালন, নাকি আব্দুল্লাহ সিগারেটের বিজ্ঞাপনের আড়ালে নিজেদের প্রচার? এ কথা দিবালোকের মতো সত্য যে, সুস্থ জীবনের জন্য ক্রীড়া বড় শক্তি। সেই স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মকাণ্ডের সহযোগিতায় ভূমিকা পালন করছিল মাদক প্রসারের প্রবেশদ্বার সিগারেট কোম্পানি! ২০০৫ সাল থেকে ২০২১। এরই মধ্যে ১৬ বছর পেরিয়ে গেছে। সিগারেট কোম্পানিগুলো কোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা বা খেলাধুলায় স্পনসর করতে পারছে না। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কোথা থেকে পেত সিগারেট কোম্পানিগুলো? সেই অর্থ এখন কোথায় ব্যয় হচ্ছে?

বাংলাদেশ-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ ঢাকায় শুরু হয়েছে। কয়েক দিন ধরেই এই ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক চলছে। প্র্যাকটিস করতে মাঠে নিজ দেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে ওড়ানোর কোনো নজির জানা নেই। পাকিস্তান ক্রিকেট দল অনেক পুরোনো ও বোনেদি। এসব বিষয়ে তারা খুব ভালো করেই জানে। তারা নিশ্চয়ই এও জানে যে, তাদের জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেই বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা অর্জন করেছে। সেই যুদ্ধে এদেশের ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে, পাঁচ লাখ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছে। তাই এ দেশের মানুষের পাকিস্তানের পতাকার প্রতি বিরূপ মনোভাব থাকা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। বাংলাদেশের পতাকায় বাড়তি আবেগ থাকাও স্বাভাবিক। মূল ম্যাচের সময় আইসিসি’র নিয়ম মেনে বাংলাদেশ নিজেই পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করবে, তা পাকিস্তানের ক্রিকেটার ও সফরসঙ্গীরা ভালো করেই জানেন। তার পরও প্র্যাকটিসের সময় মাঠে তাদের জাতীয় পতাকা নিয়ে যাওয়ার মতো অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ করেছে পাকিস্তান দল। হয়তো পাকিস্তান দল করেনি, করেছে বিশেষ একজন ক্রিকেটার। কিন্তু যেহেতু পাকিস্তান দল থেকে এ বিষয়ে কোনো দুঃখপ্রকাশ করা হয়নি, তাই বলতেই পারি যে পাকিস্তান দল এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ কাজটি করেছে। বিসিবিও এ বিষয়ে কোনো কথা বলেনি। অন্তত পাকিস্তানের যে ক্রিকেটার এমন আচরণ করেছে, তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য বলতে পারত বিসিবি।

বিসিবি এ বিষয় কেন বক্তব্য দেবেÑএমন প্রশ্ন আজ এদেশের ক্রিকেটপ্রেমী জনগণের। কারণ বিসিবি আদৌ বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু বিসিবি কি দেশের জনগণের সমালোচনার কোনো তোয়াক্কা করে? করে না। করে না বলেই টি-২০ বিশ্বকাপে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের পরও কোনো অনুশোচনা নেই বিসিবির। আর বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে না বলেই জাতীয় ক্রিকেট দলের জার্সিকে বানিয়েছে ‘দারাজ’-এর ব্যানার। এই জার্সি গায়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা পাকিস্তানের বিপক্ষে লড়ছে। জার্সিতে ‘দারাজ’ লেখার ঢং দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই মন্তব্য করছেন, পাকিস্তান বনাম দারাজের ক্রিকেট ম্যাচ। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ১৯৯৯ সাল থেকে ওয়ান ডে ম্যাচ খেলছে। প্রতিবারই কোনো না কোনো কোম্পানি ক্রিকেট দলের জার্সির স্পনসর হয়। জার্সিতে কোম্পানি তার নাম ছাপে। বিশ্বের সব ক্রিকেট দলই এই কাজ করে থাকে। কিছুদিন আগেও ক্রিকেট দলের জার্সিতে ইভ্যালির বিজ্ঞাপন ছিল। সেই ইভ্যালি এখন বিচারের কাঠগড়ায়।

বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তার ব্যবসায়িক স্বার্থে বিজ্ঞাপন প্রচার করে। এটা বাজার অর্থনীতির বড় অনুষঙ্গ। তারা নিজেদের প্রসারেই এই বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকে। অবশ্যই প্রচার বাবদ ব্যয়ের অর্থ ভোক্তার কাছ থেকেই আদায় করে থাকে কোম্পানিগুলো। কিন্তু জাতীয় কোন বিষয়ে কতটুকু গ্রহণ করা হবে, তা বিজ্ঞাপন গ্রহীতাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দেশের পরিচয় ম্লান করে দিয়ে কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সংবিৎ ফিরে পাক বিসিবি। 

গণমাধ্যমকর্মী

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০