ফারুক আলম, লালমনিরহাট: ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার নামুড়ী দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ চলতি বছরে এসে যেন ডুবতে বসেছে। অনাকাক্সিক্ষত নানা ঘটনার কারণে হারাচ্ছে জৌলুস। শিক্ষকদের দ্বন্দ্বে এ অবনতি হয়েছে বলে জানা গেছে। গত ১৫ নভেম্বর সকালে সহকারী শিক্ষক ভুপতি রঞ্জন রায় ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলামের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এতে নজরুল ইসলামের নাক ফেটে যায়, পরে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন তিনি।
শিক্ষকদের এমন আচরণ অতীতেও দেখা গেছে। কয়েক বছর আগে প্রধান শিক্ষক এন্তাজুল হক পক্ষাঘাতের কারণে দায়িত্ব ছেড়ে দেন। কমিটি সহকারী প্রধান শিক্ষককে দায়িত্ব দেয়। সহকারী প্রধান শিক্ষক কাজী আবদুর ছাত্তার ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে দায়িত্ব ছেড়ে দেন। কমিটি ২০১৮ সালে নজরুল ইসলামকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেয়। এরপর থেকেই শুরু হয় শিক্ষকদের মধ্যে নানা দ্বন্দ্ব^-বিবাদ, যা পরবর্তী সময়ে থানা ও আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
সঙ্গত কারণে অবিভাবক ও শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বিরাজ করছে তীব্র অসন্তোষ ও হতাশা।
সাবেক শিক্ষার্থী রানা বলেন, আমার দাদার বাবা এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আমি নিজেও এখানকার ছাত্র ছিলাম। কভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে বাড়িতে এসেছি। তারপর শুনছি নানা ঘটনা। সবার কাছে আমাদের একটাই আবেদন, আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচান।
এলাকাবাসীরা জানান, এ স্কুল থেকে ২০১৯ সালে ১৯ শিক্ষার্থী এ প্লাস পায়। এমন প্রতিষ্ঠানে এ ঘটনা কাম্য নয়।
খোকা মিয়া নামের একজন বলেন, শিক্ষকদের মধ্যে এমন ঘটনা দুঃখজনক, আমাদের জন্য মেনে নেয়া কষ্টকর। এর প্রতিকার হওয়া প্রয়োজন।
সায়েম নামের একজন অবিভাবক বলেন, আমার শ্বশুর বীর মুক্তিযোদ্ধা হামিদ মোল্লা তখন সভাপতি। এন্তাজুল স্যার প্যারালাইজড হয়ে অবসরে গেলে কমিটি সহকারী প্রধান শিক্ষক কাজী ছাত্তারকে প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি কয়েকদিন দায়িত্ব পালনের পর ছেড়ে দেন। তাকে বেশ কয়েকবার বোঝানো হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেন। পরে কমিটি নজরুল স্যারকে দায়িত্ব দেয়। এরপর শুরু হয় দ্বন্দ্ব।
এদিকে ভুপতি রঞ্জন রায়ের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ গভর্নিং বডি, শিক্ষক, অভিভাবক ও অফিসারদের। জানা গেছে, গভর্নিং বডি তার বেতন স্কেল এক ধাপ নিচে নামানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত মেনে ৪৮২৬৪৪ টাকা সরবারি কোষাগারে ফেরত দিতে বলা হয়। টাকা ফেরত না দিলে দুদকে মামলা করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। আর সহকারী প্রধান শিক্ষক কাজী আব্দুস ছাত্তারের উত্তোলিত ১৮৮৩০৪ টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে বলা হয় এবং তার বেতনও স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় কমিটি।
এছাড়া মেয়েদের বিরক্ত করার অভিযোগ রয়েছে ভুপতির বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব সহকারী প্রধান শিক্ষক পান। নজরুল স্যার প্রধানের দায়িত্ব নিলে আমি এর প্রতিবাদ করি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমাকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাময়িক বহিষ্কার করে। নতুন কমিটিতে কোনো শিক্ষিত মানুষকে রাখা হয়নি। আমার বিরুদ্ধে যে মেয়ে অভিযোগ করেছে, সে অভিযোগ করতে চায়নি। তাকে দিয়ে জোর করে অভিযোগ করিয়েছে। আমি তখন আমার মামা ও সভাপতি ভবরঞ্জনকে বলি, প্রধান শিক্ষক গাধার গাধা। আপনি নজরুলকে প্রধানের দায়িত্ব না দিয়ে সহকারী প্রধান কাজী ছাত্তারকে দায়িত্ব দেন। তিনি কথা শুনলেন না। এখন যে ঘটনাগুলো ঘটছে এতে মাধ্যমিক ও জেলা শিক্ষা অফিসের অবহেলাও দায়ী। আমি তাদের লিখিতভাবে বিষয়গুলো জানিয়েছি। তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
তিনি আরও বলেন, আমার মামলা ছাড়াও আরও ১১টি মামলা চলমান। মারামারির দিনও আমি সঠিক সময়ে গিয়েছি। আমি দেখলাম আমাকে অনুপস্থিত দেখানো হয়েছে। সহকারী প্রধান শিক্ষক কাজী ছাত্তার স্যারকে বললে, তিনি অনুপস্থিত লেখার ওপরেই সই করতে বলেন। আমি তাই করি। এতে দ্বন্দ্ব হয় প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে। একপর্যায়ে আমি প্রধান স্যারকে ধাক্কা দেই। আদিতমারীর একটি শ্রেষ্ঠ স্কুলকে ধ্বংস করা হচ্ছে। স্কুলটিকে বাঁচাতে হবে।
সভাপতি ভবরঞ্জন রায় বলেন, মারামারির ঘটনাসহ যা ঘটছে সেগুলো সব আপত্তিকর ঘটনা। এভাবে চলতে পারে না। ভুপতি রঞ্জনই শুধু সমস্যা করছে। আমরা মারামারির ঘটনার পরে কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। প্রধান শিক্ষক আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। আইনের মাধ্যমে যা ভালো হয় করবেন। বেতনের টাকা ফেরত দিতে রেজুলেশন করা হয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, গত চার বছর ধরে আমি দায়িত্ব পালন করছি। শিক্ষক ও গভর্নিং বডির আন্তরিকতায় স্কুলটি উপজেলার শ্রেষ্ঠ স্কুল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সবার সুদৃষ্টি কামনা করছি।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, এর আগে একটি তদন্ত করা হয়েছে। সেই তদন্ত রিপোর্ট ঢাকায় ফরওয়ার্ড করেছি। এ স্কুলটিতে স্থায়ী একজন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ করলে হয়তো সমস্যার সমাধান হবে।
ডিসি আবু জাফর বলেন, এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ কেউ করেনি, তাই জেলা প্রশাসনের মন্তব্য নেই। থানায় একটি ফৌজদারি মামলা হয়েছে, সেটা পুলিশ দেখবে।