গণপরিবহন ব্যবস্থার সংস্কার আর কত দূর?

নাঈমা আকতার:‘আজকে আমার পোলার জন্মদিন গো… আজকে আমার পোলার জন্মদিন!’ জন্মদিনে বাসের তলায় পিষ্ট হয়ে যাওয়া সন্তান দুর্জয়কে নিয়ে মায়ের আহাজারি। ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। নাকি ওঠে না! ইট-পাথরের শহরে থাকতে থাকতে আমরাও কি প্রাণহীন ইট-পাথরে পরিণত হয়ে গেছি?

বাংলাদেশে গণপরিবহন আর নৈরাজ্য যেন সমার্থক হয়ে উঠেছে। যত রকম অনিয়ম সম্ভব তার প্রতিটিই যেন রয়েছে এ খাতে। অনুমোদন থেকে পরিচালনা কোনো ক্ষেত্রে অনিয়ম নেই? প্রভাব খাটিয়ে যে কেউ কোম্পানি খুলে বাস নামাচ্ছেন, প্রায় প্রতিটি রুটে বিশেষত উত্তরা-মতিঝিল, মিরপুর-গুলিস্তান, গাবতলী-যাত্রাবাড়ীÑএ রুটগুলোয় যাতায়াতের চাহিদাও প্রচুর। তাহলে পাবলিক বাসগুলোর এ অবস্থা কেন?

বেশিরভাগ বাস রংচটে, আয়না ভাঙা, সিটগুলো এমনভাবে বসানো হয়েছে যে, একজন যাত্রীর স্বস্তি নিয়ে বসার কোনো উপায় নেই। বারবার আমরা শুনি ফিটনেসবিহীন গাড়ি আর চলবে না। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকলেও বাস্তবে কোনো পরিবর্তন দেখার সৌভাগ্য আর হয় না। সিটিং-লোকাল সার্ভিসের ক্ষেত্রেও ভোগান্তি জনগণের। সিটিং সার্ভিসের নামে দ্বিগুণ ভাড়া আর লোকাল বাসে লোকের ভিড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা। ২০১৭ সালে সিটিং সার্ভিস বন্ধে অভিযান হলে মালিক-শ্রমিকরা বাস চালানো কমিয়ে দেয়। অর্থাৎ ভোগান্তি সেই আমাদের, জনগণের।

এর সঙ্গে আছে মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা। যেখানে চালক ও শ্রমিকদের বেতনভুক্ত কর্মচারী হওয়ার কথা তার পরিবর্তে অদ্ভুত এক বিষয় দেখতে পাই আমরা। মালিকের থেকে নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে চালক বাস ভাড়া নিয়ে নেয় এবং দিন শেষে মালিককে দৈনিক জমা দিতে হয়। আর যদি বেশি আয় হয় তাহলে তা চালকের আর শ্রমিকের পকেট ভরে। ফলে প্রতিটি বাসের চালকের মধ্যে যাত্রী নেয়ার, অন্য বাসের গতিরোধ করার একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখা যায়। যার বলি হতে হয় দুর্জয়দের, আমাদের সন্তানদের, খালি হয় মায়ের বুক, ভেঙে চুরমার হয়ে যায় একটি পরিবার।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, সারাদেশের ৭৪ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে ঢাকা শহরে এবং সাম্প্রতিক সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর কারণ হিসেবে তারা বাসের বেপরোয়া চালনাকেই চিহ্নিত করেছেন। মৃত্যুকে আমরা কেউই অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে অকাল মৃত্যু কি মেনে নেয়া যায়? কেউ কি সাহস করে নিজের প্রিয়জনের মুখটা সেখানে ভাবতে পারেন? নাকি ভাবতে চান? কিন্তু প্রতিদিন কেউ না কেউ নিজের প্রিয়জনকে হারায়। বাসগুলোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা। আবার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রভাবে ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে চালকরা পার পেয়ে যায় বিভিন্ন অন্যায় করেও।

স্টিয়ারিংয়ের পেছনে যে মানুষটি থাকে, যার ভরসায় জরগণ বাসে ওঠে, সেই চালক হয় অনেক সময় অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও লাইসেন্সবিহীন। আমরা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ গড়ার দিকে এগিয়ে যেতে চাই, কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পিছিয়ে আছি বহুগুণে। কিন্তু এ থেকে উত্তরণের কি কোনো পথ নেই? আছে অবশ্যই। আমাদের গণপরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

পরিবহন খাতে নজরদারি ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন। বর্তমানে যেভাবে চুক্তিতে পাবলিক বাস চালানো হয় সেটি বন্ধ হওয়া আবশ্যক। তা না হলে অতিরিক্ত লাভের আশায় লাইসেন্সবিহীন, প্রশিক্ষণহীন ও অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক দিয়ে গাড়ি চালানো, গাড়ির অতিরিক্ত গতি, ওভারটেকিং ইত্যাদি চলতেই থাকবে। দুর্ঘটনাও চলতেই থাকবে। দেশজুড়ে সরকারি বাসসেবা চালু করা প্রয়োজন যাতে বেসরকারি খাতের স্বেচ্ছাচারিতা কমিয়ে আনা যায়।

দুর্ঘটনা হ্রাসে একজন দক্ষ চালকের গুরুত্ব অপরিসীম। পর্যাপ্ত এবং যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই একজন দক্ষ, ধৈর্যশীল ও সতর্ক চালক তৈরি সম্ভব। কারণ যানবাহন চালনার ক্ষেত্রে এ প্রতিটি বিষয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যানবাহন চালনা শুরুর পূর্বে চালকরা যেন যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত হন সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন এবং কোনোভাবেই যেন যথেষ্ট প্রশিক্ষিত হওয়া ছাড়া তারা সড়কে যান চালনার লাইসেন্স না পান সেদিকে সরকারি তদারকি থাকা আবশ্যক। এজন্য মোবাইল কোর্ট আরও সক্রিয় হতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে গাড়ির গতি হ্রাসের জন্য গতিরোধক থাকা আবশ্যক। সেই সঙ্গে ক্লাস শুরু হওয়ার সময় ও ছুটি হওয়ার সময় স্কুল-কলেজের সামনের রাস্তায় গাড়ি চলাচল নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে, যা শিক্ষার্থীদের দুর্ঘটনার আশঙ্কা হ্রাস করবে।

ট্রাফিক আইন মেনে চলার ক্ষেত্রে চালকদের আরও সচেতন করে তুলতে হবে। আমরা দেখতে পাই, আইন ভঙ্গ করার পর এমনকি মানুষ মারা যাওয়ার পরও অনেক সময় চালক-মালিকরা ছাড় পেয়ে যান, যা তাদের আরও বেপরোয়া করে তোলে। ফলে আইনে উল্লিখিত শাস্তির কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। শুধু চালক নয়, অনেক সময় পথচারীরাও হঠাৎ করেই দৌড় দিয়ে রাস্তা পার হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, কোন কোন ক্ষেত্রে চালকরা সঠিক সময় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় দুর্ঘটনা ঘটে। রাস্তা পারাপার, ট্রাফিক আইন মেনে চলার ক্ষেত্রে পথচারীদের মধ্যেও সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।

অনেক দিন থেকেই বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি বা বাস রুট র‌্যাশনালাইজেশনের কথা শোনা যাচ্ছে। এর আওতায় বাস চলবে শুধু পাঁচ-ছয়টি কোম্পানির অধীনে। যাত্রী তোলার জন্য এক বাসের সঙ্গে অন্য বাসের যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তা বন্ধ হবে এবং দুর্ঘটনার আশঙ্কাও কমবে। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ তবে চ্যালেঞ্জিং। বর্তমান মালিকদের রাজি করিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি চালু করাটা কঠিনই হবে। আগামী ২৬ ডিসেম্বর থেকে ঘাটারচর থেকে কাঁচপুর পর্যন্ত ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামের বাস রুটের পাইলটিং শুরু হওয়ার কথা। প্রত্যাশা করি, দীর্ঘদিনের এ প্রচেষ্টাটি সফল হবে এবং নগরবাসী এর সুফল পাবে।

সর্বোপরি, পাবলিক বাসের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। বর্তমানে যানজটের কারণে বাসের পুরো সক্ষমতা ব্যবহার হয় না এবং বাসে ওঠার জন্য পিক আওয়ারে বা ব্যস্ত সময়ে নগরবাসীকে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। বর্তমানে ঢাকা শহরে গাড়ির গড় গতি ৫-৬ কিলোমিটারের নিচে নেমে এসেছে যানজটের কারণে। এ অবস্থা চলমান থাকলে গাড়ির গতি হবে মানুষের হাঁটার গতি থেকেও কম। যানজটের কারণে আমাদের মূল্যবান কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় এবং সেই সঙ্গে বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। কিন্তু যানজটের ক্ষতি শুধু আর্থিক ক্ষতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দীর্ঘ সময় যানজটে বসে থেকে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে, প্রয়োজনীয় শারীরিক কার্যক্রমের সময় পাওয়া যাচ্ছে না, শিশুরা সৃষ্টিশীল কাজে সময় দিতে পারছে না আবার পরিবারকেও আমরা যথেষ্ট সময় দিতে পারছি না। অর্থাৎ এক যানজটের কারণে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও সামাজিক সব ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি আমাদের হতে হচ্ছে।

রাজধানীতে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ট্রিপ হেঁটে সংঘটিত হয়। এ শহরে ৫ শতাংশেরও কম মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে কিন্তু সড়কের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে রাখে। ঢাকা শহরে অধিকাংশ ট্রিপই স্বল্প দূরত্বের। হাঁটার উপযোগী পরিবেশ না থাকায় স্বল্প দূরত্বেও মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করছে, যা যানজট বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে হেঁটে যাতায়াতের সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করে মানুষকে স্বল্প দূরত্বে হেঁটে ও সাইকেলে যাতায়াতে উদ্বুদ্ধ করা হলে যানজট সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখা সম্ভব। তখন আমাদের পাবলিক বাসগুলোও সম্পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার সম্ভব হবে এবং যারা তুলনামূলক দূরবর্তী গন্তব্যে পাবলিক বাসে যাতায়াত করে তারা সুবিধাভোগী হতে পারবেন।

পরিবহন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত। এ খাতে সংস্কার সময়ের দাবি। প্রশ্ন থেকে যায়, কবে হবে সংস্কার? আর কত শিক্ষার্থীকে বলি হতে হবে? আর কত মায়ের বুক খালি হবে? আর কত দুর্জয়ের ভালো কলেজে পড়ার স্বপ্ন, ভবিষ্যতের স্বপ্ন চাকার তলায় পিষ্ট হবে? আর কত প্রাণ ঝরে গেলে তারপর সংস্কার দেখতে পাব?

উন্নয়ন কর্মী

naima-2810@yahoo.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০