প্রতিবন্ধী দিবস ও প্রতিপাদ্য

ফারিয়া ইয়াসমিন: আজ ৩০তম আন্তর্জাতিক ও ২৩তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস। বিভিন্ন আয়োজনে দিবসটি পালিত হবে। পৃথিবীতে আমরা যতজন মানুষ বসবাস করি সব মানুষ সুস্থ, স্বাভাবিক এবং পূর্ণাঙ্গ বিকাশপ্রাপ্ত, এমন নয়। সুস্থ ও পূর্ণাঙ্গ বিকাশপ্রাপ্ত মানুষ যেমন তেমনই অসুস্থ ও অস্বাভাবিক কিংবা ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ আছে। যারা সাধারণত অন্য সব সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের মতো নয়, শারীরিক-মানসিক বা আচরণিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা রয়েছে তাদের প্রতিবন্ধী বলা হয়। প্রতিবন্ধী মানুষ আমাদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো জনগোষ্ঠী নয়, এরা আমাদের সমাজের অংশ। একজন সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের একটা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যতটা সুযোগ গ্রহণ করার অধিকার রয়েছে, একজন প্রতিবন্ধী মানুষের ঠিক ততটাই সুযোগ গ্রহণ করার অধিকার রয়েছে বরং এদের প্রতি একটু বেশি সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা উচিত। কেননা যথাযথ সুযোগ-সুবিধা এবং বিশেষ আওতাভুক্ত করলে এদেরও জনসম্পদে পরিণত করা যায়।

বিশ্বজুড়ে প্রতিবন্ধী দিবসের অনুগামিতার পেছনে আছে এক ঘটনাবহুল জীবনস্মৃতি। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে বেলজিয়ামে এক ভয়াবহ খনি দুর্ঘটনায় বহু শ্রমিক মারা যান। আহত পাঁচ সহস্রাধিক ব্যক্তি চিরজীবনের মতো প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন। তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তাদের প্রতি সহমর্মিতায় ও পরহিতপরায়ণতায় বেশ কিছু সামাজিক সংস্থা চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের কাজে স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে এগিয়ে আসে। এর ঠিক পরের বছর জুরিখে বিশ্বের বহু সংগঠন সম্মিলিতভাবে আন্তঃদেশীয় স্তরে এক বিশাল সম্মেলন করেন। সেখান থেকেই প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে বিস্তারিত সব তথ্যের হদিস মেলে। সেখানে সর্বসম্মতভাবে প্রতিবন্ধী কল্যাণে বেশকিছু প্রস্তাব ও কর্মসূচি গৃহীত হয়। খনি দুর্ঘটনায় আহত বিপন্ন প্রতিবন্ধীদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস পালন করতে আহ্বান জানানো হয়। সেই থেকেই কালক্রমে সারা পৃথিবীর প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানোর দিন হয়ে উঠেছে।

উপযুক্ত সেবা, চিকিৎসা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সহায়ক উপকরণ পেলে প্রতিবন্ধীরাও সামাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর বিশেষ চাহিদাপূরণে এবং তাদের অধিকার রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে আন্তরিক হতে হবে। প্রতিবন্ধী দিবসে সমাজ ও রাষ্ট্রের এমন ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করার জন্য আহ্বান করা হয়। প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নমূলক কাজে সম্পৃক্তকরণ করে নতুনভাবে টেকসই বিশ্ব করা সম্ভব। তারা দেশের জন্য বোঝাস্বরূপ নয় বরং তারা উন্নয়নের কারিগরের অংশ।

শারীরিকভাবে অসম্পূর্ণ মানুষগুলোকে অনেকে বোঝা মনে করেন। এদের পারিবারিক, সামাজিকভাবে অনেক অবহেলার শিকার হতে হয়। প্রতিবন্ধিতা কোনো প্রতিবন্ধকতা নয় বরং আমাদের অবহেলার কারণে এটা প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে এরা এগিয়ে যাবে, সেই সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাবে সমাজকে, দেশকে। এদের কেউ জনসম্পদে পরিণত করা যায়, প্রয়োজন শুধু দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আর যথাযথ উদ্যোগ।

আমাদের উচিত তাদের অক্ষমতাকে সরিয়ে বিশেষ গুণাবলি বিকাশের পথ সুগম করে দেয়া। পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, চাকরি সব ক্ষেত্র থেকে বৈষম্য সরিয়ে তাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে আমাদের অবহেলা তাদের মধ্যকার ইচ্ছাশক্তিকে নষ্ট করে দেয়, তার ফলে তারা নিজেদের সমাজের বোঝা মনে করে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসংস্থান প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষায়িত কার্যক্রমের প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের উচিত প্রতিবন্ধী মানুষটার দিকে তাকানো তার অক্ষমতার দিকে নয়। এখন সময় পাল্টাচ্ছে এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন জনগোষ্ঠীরা নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। আমাদের শুধু তাদের পাশে থাকতে হবে। দেশে প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন- ২০১৩, নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন-২০১৩, বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন-২০১৮ এবং প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা, ২০১৯ প্রণয়ন করেছে। এসব আইন ও বিধিবিধানের আলোকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মৌলিক চাহিদাপূরণ, ক্ষমতায়ন এবং দেশের অন্যান্য জনগণের ন্যায় সমঅধিকার নিশ্চিতকরণে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করছে।

দেশের ৬৪ জেলা এবং ৩৮টি উপজেলায় ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং অটিজম সেন্টার চালু করা হয়েছে। দেশের সেনানিবাসে চালু করা হয়েছে ‘প্রয়াস’ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়। প্রতিবন্ধীদের বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষ বলা হয়। আসলেই এরা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এবং তাদের মাঝে অনেক আলাদা গুণাবলি রয়েছে, যেগুলো অন্য সাধারণ মানুষের মধ্যে নেই।

সবারই এটা ভাবা দরকার যে, প্রতিবন্ধীরা জাতির বোঝা নয়, সম্পদ। এরাও সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

প্রতিবন্ধিতা কোনো প্রতিবন্ধকতা নয়। সমাজের অন্য সব প্রতিবন্ধকতার ন্যায় এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন পারে এই সমস্যার সমাধান করতে। সমাজ বা রাষ্ট্রের কাজ গুটিকয়েক মানুষকে কেন্দ্র করে নয় বরং সব মানুষকে একত্র করে সামগ্রিক উন্নয়নের কথা ভাবা। হতে পারে প্রতিবন্ধী শিশুরা অন্য সব সাধারণ শিশুদের মতো নয়, তবে তাদের বুদ্ধিমত্তা, বিশেষ গুণাবলি অন্য সব শিশুদের থেকে বেশিও হতে পারে। তাদের যথাযথ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা, যেমন শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষ, বিশেষভাবে প্রণীত পাঠ্যক্রম দ্বারা শিক্ষা প্রদান করা এবং বিদ্যালয় তাদের জন্য আলাদা সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে তাদের শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষালয় তৈরি করা। অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন আইন প্রণয়ন এবং আইন কার্যকরের মধ্যে পার্থক্য থাকে, এ ক্ষেত্রে তেমন অবহেলা করলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের মধ্যে তফাত না রেখে প্রতিবন্ধী শিশুদের অন্য শিশুদের মতো সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপন করার সুযোগ দিতে হবে।

শিক্ষার্থী

শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০