সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। এ শহরকে কেন্দ্র করে সম্প্রসারিত হচ্ছে বাংলাদেশের উন্নয়ন অর্থনীতি। এতে উম্মুক্ত হচ্ছে কয়েক লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ সম্ভাবনা। আবার চট্টগ্রাম আন্তঃমহাদেশীয় যোগাযোগ ও অমীমাংসিত ইস্যুতে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারে। এছাড়া দু’বছর পর অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। এসব বিষয়কে মাথায় রেখে হঠাৎ তৎপর হয়ে উঠেছেন বিদেশি কূটনীতিক ও রাষ্ট্রদূতরা।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের প্রায় ৯০ শতাংশ পরিচালিত হয়। এ কার্যক্রমের ওপর নির্ভরশীল দেশের সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। আর বন্দর সুবিধার কারণে এ অঞ্চলে বিনিয়োগের চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে বিদেশি বিনিয়োগের জন্য জমি, অবকাঠামো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি সুবিধাসহ ওয়ান স্টপ সার্ভিস দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সরকার শিল্প স্থাপনে অনেক প্রণোদনা সুবিধা দিচ্ছে। আর এসব সুবিধা কাজে লাগাতে দেশি করপোরেটসহ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তৎপর হয়ে উঠেছেন। এ কারণে করোনা সংক্রমণ হার কম হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, কানাডা, জার্মানি, জাপান, কোরিয়া, সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, ব্রাজিল, কসবোসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূত ও বাণিজ্য প্রতিনিধিদল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সৌজন্যে সাক্ষাতে মিলিত হন।
এ সময় চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনাল নির্মাণ, জাহাজশিল্প, স্টিল, পেট্রোকেমিক্যাল, সুনীল অর্থনীতি, নবায়ানযোগ্য জ্বালানি, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্রযুক্তি খাতে বিদেশি বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। এজন্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে এফটিএ অথবা পিটিএ সম্পাদন, মানবসম্পদ উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ, বাংলাদেশে বন্ধ পাটকল চালু করার লক্ষ্যে বিনিয়োগ, প্রযুক্তি বিনিময় এবং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বানও জানানো হয়।
এসব মিটিংয়ে উপস্থিত থাকা বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, বঙ্গোপসাগর-সংলগ্ন অঞ্চল ও আসিয়ান দেশগুলো থেকে শুরু করে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান পর্যন্ত তিন বিলিয়ন মানুষের বিশাল মার্কেটে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এজন্য বিনিয়োগে আগ্রহী দেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব সৃষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ ও আইসিটি খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। এজন্য একটি হেলপ ডেস্ক স্থাপন করা দরকার। কিন্তু ব্যবসায়িক সম্পর্কের আড়ালে কোনো কোনো দেশ বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টার সুযোগও নিতে পারে। অতীতে আমরা তাদের প্রভাব দেখেছি। হয়তো এখন তাদের সেই সুযোগ নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম চেম্বারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপকালে জার্মানির দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স কনস্টানজা জায়েহরিঙ্গার বলেন, চট্টগ্রামে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। ওএভি জার্মান এশিয়া-প্যাসিফিক বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের একটি বাণিজ্য প্রতিনিধিদল ২০১৯ সালে চিটাগং চেম্বার নেতাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিষয়ে মতবিনিময় করে। এরই ধারাবাহিকতায় করোনা পরিস্থিতির উন্নয়ন সাপেক্ষে আবারও জার্মানি থেকে বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের চট্টগ্রাম সফরের পরিকল্পনা রয়েছে। উভয় দেশের বেসরকারি খাতের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধির ফলে যৌথ উদ্যোগসহ বিনিয়োগের পথ আরও প্রশস্ত হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ অনেক খাতেই জার্মানির বিনিয়োগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। তাই জার্মানিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্য প্রতিনিধিদল পাঠানো হলে তা কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
অন্যদিকে তুরস্ক ও বাংলাদেশের মধ্যে ১১০ কোটি ডলারের বাণিজ্যকে ২০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার আশাবাদ ব্যক্ত করে তুরস্ক বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের চেয়ারপারসন হুলিয়া জেডিক বলেন, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য নয়, বরং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আর তুরস্ক যেসব পণ্য নিজে উৎপাদন করে না, সেসব পণ্য বাংলাদেশ থেকে আমদানি করতে পারে। কারণ বাংলাদেশের অবকাঠামো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, আইসিটি, ইস্পাত, প্রকৌশল, শিক্ষা প্রভৃতি খাতে তুর্কি বিনিয়োগকারীদের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নে উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়নের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন এবং ইস্তাম্বুল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে চট্টগ্রামের ১০ ছাত্রছাত্রীকে স্কলারশিপ প্রদানের ঘোষণা দেন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি ও সার্ক চেম্বারের সহসভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বাংলাদেশ সরকার বিদেশি বিনিয়োগের জন্য ট্যাক্স হলিডেসহ নানা সুবিধা দিচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিনিয়োগের জন্য আদর্শ স্থান হিসেবে গড়ে তুলছে। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে দেশের ৯২ শতাংশ রপ্তানি ও ৮৫ শতাংশ আমদানি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। আর মিরসরাই ইকোনমিক জোনে ওয়ান স্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। এ শিল্পাঞ্চলে জাপান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ বিনিয়োগের জন্য বিশেষ জোন নির্মাণে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব পেয়েছে। তবে দ্রুত সময়ে এ শিল্পাঞ্চলের পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এতে বিনিয়োগ আরও গতিশীল হবে। আর বিদেশি উদ্যোক্তারা বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে শিল্পকারখানা স্থাপন করে ১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানির সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং সম্ভাবনা ব্যাপক। তাই সব সংস্থার সমন্বয়ে এগিয়ে যেতে হবে।