মানবজীবনে শিষ্টাচার, ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধ

মো. জিল্লুর রহমান: সম্প্রতি একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির কিছু অযাচিত ও অশোভন মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচনার ঝড় তুলেছে। তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ট্রল হচ্ছে। এরই মধ্যে তাকে তার পদ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে মানবজীবনে শিষ্টাচার, ভদ্রতা ও সৌজন্যতাবোধের গুরুত্ব ও তাৎপর্য কতটুকু। যদিও শিষ্টাচার ব্যক্তিজীবনে যেমন, তেমনি সমাজজীবনেরও গৌরবসূচক আভরণ। শিষ্টাচার, ভদ্রতা ও সৌজন্যতাবোধ মানুষের চরিত্রের মুকুট বা অলংকার। অনেকেই এ গুণগুলো ধারণ ও অর্জন করতে পারে না। আচরণে যদি মানুষ শিষ্ট না হয়, ব্যবহারে উগ্রতা যদি পরিহার না করে, তবে কখনও শিষ্টাচারী হওয়া সম্ভব নয়। স্বভাবে কৃত্রিমতা পরিহার করতে না পারলে কখনও পবিত্র মনের অধিকারী হওয়া যায় না। দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, দেহের সৌন্দর্যের চেয়ে চিন্তার সৌন্দর্য অধিকতর মোহময় এবং এর প্রভাব জাদুতুল্য।’ অন্যদিকে এরিস্টটল বলেছেন, ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হলো শিক্ষা।’

সমাজজীবনের ভারসাম্য, শৃঙ্খলা, উন্নতি ও অগ্রসরতা অব্যাহত রাখতে পারস্পরিক শিষ্টাচার, ভদ্রতা, সৌজন্যতা ও অন্যান্য মানবিক মূল্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো জাতিকে সুসভ্য ও সফলরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে এর বিকল্প নেই। আমাদের বিদ্যমান অশান্ত সমাজে শান্তি ও স্থিতি আনতে হলে সবাইকে শিষ্টাচারসম্পন্ন হতে হবে। কারণ শিষ্টাচারসম্পন্ন মানুষ কোনো তুচ্ছ বিষয়ে নিজেকে জড়ায় না, কারও সঙ্গে শত্রুতা করে না, বা কারও স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটানোর চেষ্টা করে না। শিষ্টাচার হচ্ছে ভদ্র, মার্জিত ও রুচিসম্মত আচরণের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ।

আক্ষরিকভাবে মার্জিত, ভদ্র ও পরিশীলিত আচরণই শিষ্টাচার নামে পরিচিত। ব্যুৎপত্তিগত অর্থ থেকে সুজনের ভাবকে আমরা ‘সৌজন্য’ বলি। কিন্তু তার যে ব্যবহারিক অর্থ আমাদের মধ্যে প্রচলিত, তার সঙ্গে শিষ্টাচারের বিশেষ পার্থক্য নেই। সুতরাং শিষ্টাচার ও সৌজন্যকে সমার্থক রূপেই সাধারণত গণ্য করা যায়। অপরের সুবিধা-অসুবিধা, মতামত ও অনুভূতির প্রতি সম্মান করে চলাই শিষ্টাচার ও সৌজন্যের লক্ষ্য। তা থেকে বোঝা যায়, শিষ্টাচার ব্যক্তিগত গুণ হলেও সমাজের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক। বস্তুত তা একটি স্বাভাবিক গুণ। অন্যদিকে ভদ্রতা হলো সব মানুষের প্রতি সমান দৃষ্টি, আর খোশামুদির দৃষ্টি কেবল নিজের প্রতি নিবদ্ধ। শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধ নিজের অসুবিধা করে পরের সুবিধা করে দিতে উৎসুক; খোশামোদ-বৃত্তি বোঝে শুধু নিজের সুবিধা আর খোঁজে আত্মসুখ ও আত্মসমৃদ্ধি। অন্যদিকে শিষ্টাচার বা সৌজন্যবোধ বোঝে সৌষ্ঠবমণ্ডিত, সরল ও সুন্দর কিছু।

শিষ্টাচার ও ভদ্রতা শিক্ষার বিষয়। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত হলেই যে এগুলো অর্জন করা যায়, বিষয়টা এমন নয়। এর জন্য কোনো রকম অর্থ ব্যয় হয় না বটে; কিন্তু সাধনার প্রয়োজন। সামান্য চেষ্টা করলেই যেখানে শিষ্ট ও সুজন বলে পরিচিত হতে পারি, সেখানে শিষ্টাচার বা শিক্ষার পক্ষে কোনো রকম যুক্তিই থাকতে পারে না। অন্যান্য গুণের মতো এ গুণটির শিক্ষাকালও শৈশব ও ছাত্রজীবন। ছাত্রজীবনে যে শিক্ষা দেয়া হয়, কর্মজীবনেও তা আমাদের প্রভাবিত করে। ছাত্রজীবনে শিষ্ট না হতে পারলে কর্মজীবনেও আমরা সফলতা লাভ করতে পারব না। সমাজের সব স্তরেই শিষ্টাচারের প্রয়োজন। স্কুল-কলেজে, অফিস-আদালতে ও সভা-সমিতিতে বাসে ট্রেনে সব জায়গাতেই আমাদের কতকগুলো সৌজন্যমূলক বিধি মেনে চলা উচিত। শুধু সামাজিক নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনেও শিষ্টাচার আবশ্যক হয়।

শিষ্টাচারের বীজ মূলত বপিত হয় শিশুকালে। আর এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা প্রধান। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। পরিবারের বড়রা যে রকম ব্যবহার করে, শিশুরা তা-ই অনুকরণ করে। বাল্যকালে শিশুদের সংযম, বিনয় ও উন্নত রুচির চর্চা ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে শিষ্টাচার গড়ে তোলে। যে ব্যক্তি শিষ্টাচার অর্জন করতে পারে না, তার মানুষ হয়ে জš§ানোর কোনো সার্থকতা নেই। শিষ্টাচারহীন উদ্ধত মানুষ কেবল আকৃতির দিক থেকেই মানুষ, তাদের মনুষ্যত্বের কোনো বিকাশ ঘটে না। ফলে তারা সমাজের চোখে হয়ে থাকে ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ-সদৃশ। সমাজ তাদের ভালো দৃষ্টিতে দেখে না, তাকে কেউ সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধও দেখায় না।

অ্যাকাডেমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়ালেখা করে শিক্ষিত হওয়া যায়, মেধাবী হলে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে দেশের সীমানা পেরিয়ে ভিনদেশেও নাম কুড়ানো যায়; কিন্তু পরিবার থেকে সুশিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ না পেলে একসময় সব শিক্ষাই ম্লান হয়ে যায়। প্রত্যেক মানুষের সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হলো পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা। কারণ সভ্যতা, ভদ্রতা, নৈতিকতা, কৃতজ্ঞতা বোধ, অপরের প্রতি শ্রদ্ধা-স্নেহ, পরোপকার, উদার মানসিকতা এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খুব বেশি অর্জন করা যায় না। এগুলোর ভিত্তি প্রোথিত হয় পারিবারিক মূল্যবোধ লালনপালন ও সুশিক্ষার মাধ্যমে।

মানুষ প্রাচীনকালে যখন বর্বরতাপূর্ণ ও বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করত, বনেবাদাড়ে বসবাস করত, তখন তার পক্ষে শিষ্টাচারের কোনো আবশ্যকতাই অনুভব করা যায়নি। কিন্তু যখন মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপন করতে শুরু করল, তখন থেকে তাদের মধ্যে কতকগুলো সামাজিক সম্পর্কের আবির্ভাব ঘটল, আর সেগুলোকে অক্ষুন্ন রাখার জন্যই প্রয়োজন হলো শিষ্টাচারের। সমাজে বাস করতে হলে পাঁচজনের সংস্পর্শে আসতেই হয় এবং তাদের সঙ্গে প্রীতি, সৌজন্যতাবোধ ও সখ্য বজায় রাখতে হয়। একমাত্র শিষ্টাচারের মাধ্যমেই তা সম্ভবপর। সমাজের বসবাসকারী লোকের সঙ্গে কেউ যদি অশিষ্ট ও অভদ্র আচরণ করে, তবে সে স্বভাবতই তাদের বিরাগভাজন হয়ে পড়ে এবং ব্যক্তিগতভাবে আপনার জীবনের সাফল্যকে বিঘ্নিত করে।

প্রসঙ্গত স্মরণীয়, বিদ্যা ও পাণ্ডিত্যের সঙ্গে শিষ্টাচারের বিশেষ সম্পর্ক নেই। খ্যাতনামা পণ্ডিতও অশিষ্ট হতে পারেন, তবে তাও সত্য যে, প্রকৃত বিদ্যা যেমন বিনয় দান করে, তেমনি তা মানুষকে শিষ্ট ও সুজন হতেও শিক্ষা দেয়। কেউ কেউ বলতে পারেন শিষ্টাচার রক্ষা করতে হলে সত্যকে অনেক সময় ক্ষুন্ন করতে হবে। কিন্তু সে রকম আশঙ্কার কারণ নেই। প্রকৃত সত্যাচরণের অর্থ অন্যের হৃদয়বেদনার কারণ হওয়া নয়। দু-একটি বিশেষ ক্ষেত্র বাদ দিলে সত্য ভাষণের সঙ্গে শিষ্টাচারের বিরোধ বড় একটি পরিলক্ষিত হয় না।

একজন মানুষ ভালো না মন্দ, তা বিবেচিত হয় মূলত সে ব্যক্তির আচরণ দেখেই। এগুণ মানুষকে সংযমী ও বিনয়ী করে তোলে। শিষ্টাচারসম্পন্ন ব্যক্তি তার ভদ্র ও সংযত ব্যবহার দিয়ে যেকোনো পরিস্থিতিতে যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে। এমন মানুষকে সবাই শ্রদ্ধা করেÑহোক সে ব্যক্তি অসুন্দর, কিংবা গরিব। ইসলামেও শিষ্টাচার ও সৌজন্যতাকে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শিষ্টাচারের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই উত্তম চরিত্র, ভালো ব্যবহার ও পরিমিত ব্যয় বা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা নবুয়তের ২৫ ভাগের এক ভাগ।’ (আবু দাউদ: ৪৭৭৬)। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘তুমি আদব ও শিষ্টাচার অন্বেষণ কর; কারণ আদব হলো বুদ্ধির পরিপূরক, ব্যক্তিত্বের প্রমাণ, নিঃসঙ্গতায় ঘনিষ্ঠ সহচর, প্রবাসজীবনের সঙ্গী এবং অভাবের সময়ে সম্পদ।’

পৃথিবীতে যারা মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন, তারা শিষ্টাচার ও মার্জিত ব্যবহারের মাধ্যমেই মানুষের মন জয় করে নিয়েছেন। প্রত্যেক ধর্মে আদব ও শিষ্টাচারের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মহানবী (স.) ছিলেন শিষ্টাচারের মূর্ত প্রতীক। উন্নত ব্যবহারের জন্য তিনি ছোট-বড় সবার কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। সংযম, বিনয় ও ভদ্রতা তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। কখনও তিনি কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেননি, উদ্ধত আচরণ করেননি। এ কারণেই যুগে যুগে মানুষের কাছে তিনি এত শ্রদ্ধার পাত্র। তবে এগুণ হঠাৎ করে কারও মধ্যে গড়ে ওঠে না। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ প্রস্তুতি, সাধনা ও শিক্ষা।

আপামর স্বার্থেও সামাজিক মানুষের পক্ষে শিষ্টাচার অপরিহার্য। মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি ও শান্তিকে তাই সহজলভ্য করে তুলতে পারে। অনেকে শিষ্টাচার ও ভদ্রতার মধ্যে একটি সীমারেখা টেনে থাকেন। তাঁদের মতে শিষ্টাচার আন্তরিক গুণ, আর ভদ্রতা বাহ্যিক আচরণ মাত্র। ভদ্রতা অনেক সময়েই শুধু মৌখিক ও কৃত্রিম; কিন্তু শিষ্টাচার মার্জিত রুচিসম্পন্ন হƒদয়ের স্বীয় গুণ। আমরা দুটিকে পৃথক করে দেখতে রাজি নই। মৌখিকই হোক আর আন্তরিকই হোক, অপরের প্রতি ভদ্র ব্যবহার করাই শিষ্টাচার। কারণ তা দ্বারা শিষ্টাচারের উদ্দেশ্য সফল হয়। মৌখিকভাবে কারও প্রতি শিষ্ট ব্যবহার করলে আমার প্রতি তার কোনোরূপ বিরাগ জš§ানোর হেতু দেখি না। অধিকন্তু মৌখিকভাবে ভদ্র ব্যবহার করতে করতে তা আন্তরিক গুণে পরিণত হতে পারে।

বর্তমানে আন্তর্জাতিকতার দিকে এক রাষ্ট্রের সঙ্গে অপর রাষ্ট্রের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান। রাষ্ট্রদূতদের অবশ্যই শিষ্ট হতে হয়, কূটনৈতিকতা বজায় রাখার জন্য নানারূপ সৌজন্যমূলক আচরণ করতে হয়। মানুষের সদ্গুণাবলির মধ্যে শিষ্টাচার যে অন্যতম প্রধান গুণ, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। The greatest ornament of an illustrious life is modesty and humility.একথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। শিষ্টাচার ও সৌজন্য ব্যক্তিজীবনকে সফল ও জনপ্রিয় করে তোলে।

শিষ্টাচার-বহির্ভূত লোক সমাজে কোনো মর্যাদায় ভূষিত হয় না। সমাজে শিষ্টাচারের অভাব নৈতিক অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে। সমাজজীবন হয়ে ওঠে অশান্তিপূর্ণ। নানা কদর্যতা ও অন্যায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে সমাজে বসবাসকারী মানুষরা ভোগে অস্তিত্বের সংকটে। কথায় আছে, ‘দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য।’ দুর্জনের স্বভাব ও ধর্ম অন্যের ক্ষতি করা। তাই কোনো শিক্ষিত লোক যদি চরিত্রহীন হয়, তবে অবশ্যই তার সঙ্গ পরিহার করা উচিত। কারণ তার কাছ থেকে উপকার পাওয়ার চেয়ে বরং ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা বেশি। শিষ্টাচার একটি দেশ ও জাতির উন্নত মননের প্রতীক। তাই আসুন, শিষ্টাচারসম্পন্ন জীবন গড়ি, আলোকিত সমাজ গড়ি।

ব্যাংক কর্মকর্তা ও মুক্ত লেখক

rbbbp@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০