প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনে ছাত্রদের করণীয়

মাইন উদ্দীন হাসান: ব্রিটিশদের অধীনে ২০০ বছর এবং পাকিস্তানের অধীনে ২৪ বছর পার করে পরাধীনতার শেকল ভেঙে স্বাধীন সুধা পানে আমাদের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রার ৫০ বছর পূর্ণ হলো। তবে স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশত বছরে এসেও কি আমরা বলতে পারি, আমরা প্রকৃতভাবে স্বাধীন? স্বাধীনতা মানে দেশকে শুধু দুষ্টচক্রের কবল থেকে ছিনিয়ে আনা নয়Ñস্বাধীনতা মানে দেশেকে সব আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা; স্বাধীনতা মানে, সুশাসন, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্ত চিন্তার দুয়ার খুলে দেয়া। অথচ স্বাধীনতার অর্ধশত বছরে পদাপর্ণ করেও পূর্ণ স্বাধীনতা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ রয়েই গেল!

স্বাধীন দেশের একজন নাগরিকের অধিকার থাকে আত্মসমালোচনা ও আত্মোপলব্ধির। কিন্তু এই আত্মসমালোচনা ও আত্মোপলব্ধির জায়গাটুকুতে আমাদের সমাজ কতখানি নিশ্চিন্ত। স্বাধীনতার মূলমন্ত্র সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচার স্বাধীনতার অর্ধশত বছরে এসে কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে! আমরা মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও পরাধীনতার শেকল গলায় ঝোলানো। গণতন্ত্র সাধারণ নাগরিকের কাছে আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্র সব নাগরিকের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য গণতন্ত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা বাস্তবায়িত হওয়ার সামন্যতম লেশমাত্র আমাদের মাঝে নেই, সীমাবদ্ধ থেকে গেছে গুটিকয়েক বিত্তশালী ও ক্ষমতাবান লোকের কাছে। স্বাধীন দেশে বসবাস করা সত্ত্বেও প্রকৃত স্বাধীন হতে পারেনি দেশের সাধারণ মানুষ। পরাধীনতার গ্লানি স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কুরে কুরে খাচ্ছে আমাদের।

স্বাধীনতা হলো মুক্ত বিহঙ্গে উড়তে থাকা পাখির মতো। তবে বর্তমান সময়টাতে সেই পাখিটার আকাশে উড়তে যেন মানা। চেষ্টা করা হচ্ছে তাকে আটকে রাখার। অবরুদ্ধ করা হচ্ছে যুক্তির সঙ্গে মুক্তির সুড়ঙ্গে পৌঁছানোর পথ। স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ হলো, দেশের পাশাপাশি নাগরিকের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা। একজন নাগরিকের জীবনের সঙ্গে নানা বিষয়াদি জড়িত। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকÑএই সবকিছুতে সে তার মুক্ত চিন্তা ও বলার বিকাশ ঘটাতে চায়। কিন্তু খর্ব করা হচ্ছে নাগরিকের এই অধিকার। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল অনুপ্রেরণায় ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি, দারিদ্র্য ও শ্রেণিবৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠনের এক দৃঢ় প্রত্যয়, যা বাস্তবায়নে ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির এক রক্তক্ষয়ী পথ পাড়ি দিয়ে পাকিস্তান থেকে এদেশ অর্জন করে নেয় স্বাধীনতা। দেখতে দেখতে পূর্ণ হলো স্বাধীনতার ৫০ বছর। তবুও অপূর্ণ থেকে গেছে স্বাধীনতা অর্জনের মূলনীতিগুলো। থেকে গেছে প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের পথে নানা অন্তরায়।

বিচার পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরে া কতখানি বাস্তবায়িত হলো! ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন শক্তিশালী, স্বাধীন ও জনগণের আস্থাশীল বিচার বিভাগ। কিন্তু দেশের বিচার বিভাগ সেই আস্থা কি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে! দেশের বিচার বিভাগে কত বিচার ঝুলে আছে, তা হিসেবের বাইরে। অন্যদিকে যা বিচার হয়, সেখানে চলে ন্যায়বিচারের নামে প্রহসন। ক্ষমতার জোরে নির্দোষের ওপর ছাপানো হয় দোষ। এভাবে প্রতিনিয়ত অন্যায় ও অত্যাচারের মুখোমুখি হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ।

বিঘিœত হচ্ছে নারীর নিরাপত্তা। পত্রিকার পাতা খুললে দেখা যায় ধর্ষণের অবাধ বিস্তার। ঘর থেকে বের হলেই নারীর মাঝে কাজ করে আতঙ্ক। স্বামীর সঙ্গে থেকেও নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, যার জ্বলন্ত উদাহরণ সিলেটের এমসি কলেজের ধর্ষণের ঘটনা। ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে সিলেট এমসি কলেজে ধর্ষণের শিকার হন এক তরুণী। ২০২০ সালে তিন হাজার ৪৪০ নারী ধর্ষিত হন। নিরাপদ ও স্বাধীন চলাফেরার সুযোগ স্বাধীনতার পাঁচ দশকেও বাস্তবায়িত হয়নি; ব্যবস্থা নেয়া হয়নি ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগের।

সামাজিক বৈষম্যের কালো থাবা চারদিকে বিরাজমান। যেখানে প্রত্যেক নাগরিক অধিকার রাখে সু®ু¤ভাবে সমাজে বেঁচে থাকার, সেখানে তৈরি করা দেয়া হয়েছে ধনী-গরিব নামের মহাপ্রাচীর। বৈষম্যের শিকার হচ্ছে গরিব শ্রেণির মানুষ, যা সমাজে নির্বিঘেœ বসবাস করার অধিকারটুকু

কেড়ে নিচ্ছে।

এছাড়া রয়েছে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, প্রশ্ন ফাঁস, নৈতিকতার অবক্ষয়, যা একের পর এক স্বাধীনতা অর্জনের মহান পথে অন্তরায় হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

ছাত্রসমাজের করণীয়: ছাত্রসমাজ যে কোনো অধিকার আদায়ে সচেষ্ট, যার চিত্র আমরা দেখতে পাই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ১৯৯০ সালের স্বৈরচারবিরোধী আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী ও নিরাপদ সড়কের দাবিসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এদেশের ছাত্রসমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল।

ছাত্রসমাজ জাতির চালিকাশক্তি। ছাত্রসমাজকে রুখে দিতে হবে সব অন্যায়-অত্যাচার। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে আদায় করে নিতে হবে প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের পথ, যেভাবে তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে। উর্দুকে যখন পাকিস্তানিরা বাঙালির ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, তখন বলিষ্ঠ কণ্ঠে ছাত্রসমাজ দাঁড়িয়ে যায় প্রতিবাদে। পরবর্তীকালে এই আন্দোলনই স্বাধীনতা অর্জেনের পথ সুগম করে দিয়েছিল। ভাষা আন্দোলন ছিল ছাত্রসমাজের অনুপ্রেরণার উৎস। এদেশ আর পেছাতে পারে না, যে কোনো মূল্যে এগিয়ে যেতে হবে, যেখানে ছাত্রসমাজের ভূমিকা বাঞ্ছনীয়।

ছাত্রসমাজকে কাজ করতে হবে সমাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সব অনিয়মের বিরুদ্ধে। একজন ছাত্রের প্রথম কাজ হবে নিজেকে জ্ঞানী, ন্যায়পরায়ণ, সৎ, চরিত্রবান ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। কথায় আছে, পৃথিবীকে গড়তে হলে সবার আগে নিজেকে গড়ো। দ্বিতীয়ত, দেশ ও সমাজের সব প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। তৃতীয়ত, ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে নিজের মাঝে প্রতিবাদী মানসিকতা ফুটিয়ে তুলতে হবে এবং শিক্ষাঙ্গনের সুপ্ত পরিবেশ বজায় রাখতে ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ মানসিকতা তৈরি করে নিতে হবে। চতুর্থত, সবার মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রবাদ আছে ‘দশের লাঠি, একের বোঝা।’ যদি ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ছাত্রসমাজ গড়ে তুলতে পারে, তাহলে কোনো অপশক্তি তাদের পথ অবরুদ্ধ করে রাখতে সক্ষম হবে না। পরিশেষে প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের পরিপূর্ণতার পথে আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলো বের করে তা আদায়ের জন্য ছাত্রসমাজকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এবং প্রকৃত স্বাধীনতা সেদিনই আকাশে ডানা মেলে উড়বে, যেদিন ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো নিজ জীবনে প্রতিফলন করতে পারবে। জয় হোক প্রজন্মের, জয় হোক ছাত্রসমাজের। বাঙালির জাতিসত্তার বিকাশ নতুনভাবে প্রস্ফুটিত হোক ছাত্রসমাজের হাত ধরেই। ছাত্রসমাজের আরেকটি ঐতিহাসিক অর্জন সূচিত হোক, যে অর্জনটি হবে প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের বাধা মোকাবিলায়।

শিক্ষার্থী

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০