সিপিডির সম্মেলনের সমাপনী দিনে বক্তারা

সবার জন্য সামাজিক সুরক্ষা স্কিম চালু করতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক: খাদ্য চাহিদা মেটানো ও জীবন নির্বাহ করতে গিয়ে দারিদ্র্য বেড়েছে। দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে আয়ের ক্ষেত্রেও। মানুষের আয় কমে গেছে। হারিয়ে গেছেন অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। এসব বিষয়ে কোনো গবেষণা নেই। বর্তমানে কোনো এক শিশু জন্মের পরই অভিভাবকদের সঞ্চয়ের পরিকল্পনা করতে হয়। এ জন্য চিকিৎসা, শিক্ষাসহ নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করে সবার জন্য সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা স্কিম চালু করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলছেন, করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি এখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। কিন্তু বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করলেও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, নিম্ন আয়ের ব্যক্তি বিশেষ করে চাকরিজীবীরা এ তালিকায় থাকতে পারছেন না। সবার অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রয়োজন। ‘বাংলাদেশ ইমার্জিং ফ্রম দ্য প্যান্ডেমিক: কোপিং এক্সপেরিয়েন্সেস অ্যান্ড পলিসি চয়েসেস’ শীর্ষক দুদিনের এক সম্মেলনে এমন প্রস্তাবনা তুলে ধরেন দেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদরা।

গতকাল ছিল সম্মেলনটির শেষ দিন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম যৌথভাবে সম্মেলনটি আয়োজন করে। রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে সহযোগিতা করে অ্যাকশনএইড, ক্রিশ্চিয়ান এইড, ফ্রেডরিখ এবার্ট শিপটাং, কো-অপারেশন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, ওয়াটারএইড ও জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনডিপি)।

শেষ দিনেও একাধিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সমাপনী অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। আলোচনায় অংশ নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, শিক্ষাব্যবস্থায় ডিজিটাইজেশন তথা অনলাইন সম্পৃক্ত হয়েছে। এতে ব্যয় বেড়ে যাবে। এর ফলে শহর ও গ্রামে শিক্ষার্থীর মধ্যে থাকা বৈষম্য ও অসমতা আরও বৃদ্ধি পাবে। কারণ হচ্ছে, মোবাইলসহ উপকরণে খরচ বৃদ্ধি পাবে।

তিনি আরও বলেন, করোনা মহামারি এখনও চলছে। এখন প্রাদুর্ভাব একটু কম। করোনায় বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণোদনা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। প্রণোদনার ঋণ বড় প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই পেয়েছে। এ জন্য তারা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সমস্যা দেখা দিয়েছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বেলায়। তারা যে ঋণ পাননি, তা এসএমই ঋণ বিতরণের হার দেখলেই বুঝা যায়। অথচ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানই এক সময়ে বড় হয়। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সংখ্যাই বেশি। করোনা প্রাদুর্ভাবে অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হারিয়ে গিয়েছেন। তাদের বিষয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।

নতুন দারিদ্র্য হওয়ার সঙ্গে রয়েছে দারিদ্র্যসীমার ওপরে থাকা ব্যক্তিরা। তারা সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন। যেকোনো সময়ে ফের দরিদ্র হয়ে যাবেন। আয় বৃদ্ধি না পাওয়ায় এ সমস্যা হচ্ছে। এটি সুখকর নয় আমাদের দেশের জন্য। হঠাৎ দরিদ্র হলে সামাজিকভাবে সহায়তা পাওয়া যায়। কিন্তু এবারের প্রাদুর্ভাব প্রমাণ করল একে অপরকে সহায়তা করার সুযোগ ছিল না বলে জানান তিনি।

মূল প্রবন্ধে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য উল্লেখ করেন, হতদরিদ্রদের গত ৫০ বছরের অসম্পূর্ণতা হলো ধনী-দরিদ্র, ভোগ, শিক্ষা ও চিকিৎসায় বৈষম্য কমেনিÑউল্টো বেড়েছে। এর সমাধান হচ্ছে শিক্ষার মান উন্নয়ন। এটি না হলে আন্তর্জাতিক মানে যেতে পারবে না। আমাদের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী পণ্য সম্প্রসারণ ও পণ্যর বৈচিত্র্য আনা যায়। এটি প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শান্তিপূর্ণ ও বৈষম্যহীন পথে যেতে চাই। অসম্পূর্ণ বিষয়গুলো স্বীকার করতে হবে। তা স্বীকার করেই এগিয়ে যেতে হবে।

আলোচনায় যুক্ত হয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হাসান বলেন, এখন অর্থনীতি উত্তরণের পথে রয়েছে। বিভিন্ন সূচক দেখলেই বিষয়টি বোঝা যায়। কিন্তু এখন কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে অভ্যন্তরীণ বাজারে বাড়ানো হলো। কিন্তু তড়িঘড়ি করেই তা করা হলো। জ্বালনি তেলের দাম বৃদ্ধির নীতিমালাই কী হবে, তা ভাবা দরকার।

এখন মূল্যস্ফীতি কমানো ও বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। এখন বিনিয়োগ বাড়ানোর সময়। কিন্তু টাকার অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। ডলারের বিনিময় মূল্য বাড়ছে। তিনটি সূচক সমন্বয় করা কীভাবে সম্ভব? আমরা ঋণসুদ হার নির্ধারণ করে দিয়েছি। কিন্তু আমানত সুদহার উম্মুক্ত রেখেছি। এখন মূল্যস্ফীতি বাড়লে সুদহার বাড়ছে, আবার ব্যাংকের স্প্রেড কমে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় বিনিয়োগের জন্য ঋণ দেয়া কীভাবে সম্ভব? এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ সুদহার নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে পারে, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে। এ জন্য নীতি সংস্কার করা প্রয়োজন। করোনার প্রভাবে কোন সময়ে কতুটুকু প্রভাব রেখেছে, তা নিয়ে বিশদ গবেষণা হওয়া দরকার। ভবিষ্যতে লকডাউন বা প্রাদুর্ভাবে কোন সময়ে কী ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবেÑতা জানা যাবে বলে প্রস্তাব করেন খ্যাতিমান এ অর্থনীতিবিদ।

এর আগে অনুষ্ঠিত সকালের অধিবেশনে আলোচনায় উঠে আসে, চাকরিজীবীদের ৪০ শতাংশেরও বেশি মানুষ বেশ খারাপ অবস্থায় রয়েছেন। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় জীবনযাত্রার খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে কর্মহীন ও স্বল্প আয়ের মানুষ।

আলোচকরা বলেন, বর্তমানে চিকিৎসা করতে সামর্থ্যরে বাইরে অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে নাগরিকদের। রাষ্ট্রকেই চিকিৎসা, শিক্ষা ও স্বল্প আয়ের মানুষসহ সবার জন্য সামাজিক সুরক্ষার স্কিম চালু করতে হবে। যেমনÑসরকারি কর্মচারীদের জন্য পেনশন সুবিধা রয়েছে, ঠিক তেমনি সামাজিক সুরক্ষার আওতায় প্রতিটি নাগরিককে আনতে হবে। অর্থনীতি ও জীবিকার উন্নয়ন একসঙ্গে করা প্রয়োজন।

করোনার প্রভাবে গত বছরের এপ্রিল ও মে মাসে অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছে। শহরের তুলনায় গ্রামে চরম দারিদ্র্যের হারও বেড়েছে বেশ। এছাড়া বস্তিবাসীর দৈনিক আয় কমেছে ৮২ শতাংশ। টিকে থাকতে কর্মহীন ও স্বল্প আয়ের মানুষ কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছে বাজার তালিকায় বলে উল্লেখ করেন আলোচকরা।

সিপিডি সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, যারা উদ্যোক্তা ছিলেন, তারা কৃষি খাতে গিয়ে আর উদ্যোক্তা থাকতে পারেননি। গত ২০ বছরে কৃষিতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে ১১৯ শতাংশ। বিপরীতে এ খাতে পুরুষের অংশগ্রহণ কমেছে দুই শতাংশ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, শোভন কর্মসৃজন নিশ্চিতকল্পে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের হালনাগাদ তথ্য থাকা দরকার। তথ্য না থাকলে নীতি সংস্কার করা সম্ভব নয়। সমাজের বিভিন্ন খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের আয়ের ভিত্তিতে শ্রেণিবিন্যাস করা প্রয়োজন। সেই শ্রেণিবিন্যাসের আলোকেই উন্নয়ন কর্মসূচি নেয়া যেতে পারে। তাদের মধ্যে উন্নতির প্রবৃদ্ধির ধারাও মূল্যায়ন করা যেতে পারে। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ নীতিমালা প্রয়োজন। কভিডের মতো মহামারি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব দেখা দিয়েছে।

সিপিডির বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য পারভীন মাহমুদের সঞ্চালনায় সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন অর্থনীতিবিদ শরমিন্দ নিলোর্মি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০