নিজস্ব প্রতিবেদক: টেকসই উন্নয়নের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার সবক্ষেত্রে উন্নয়নের ভারসাম্য রক্ষা করার তাগিত দিয়েছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামছুল হক। তিনি বলেন, বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন শুধু এক (সড়ক) কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। আজকের (গতকাল) সেমিনারে বলা হয়েছে সহজ, টেকসই ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা। কিন্তু আমি কোথাও সেই উন্নয়ন দেখতে পারছি না। আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু টেকসই উন্নয়নে ঘাটতি রয়েছে।
গতকাল শুক্রবার রাজধানী তেজগাঁও এলাকার সড়ক ভবন অডিটোরিয়ামে আয়োজিত ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণ অভিযাত্রা: সহজ, টেকসই ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা শীর্ষক সেমিনারে ড. শামছুল হক এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুমাত্রিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করেই প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি রেল, নৌ, সড়ক খাতে সমান গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা সে জায়গা থেকে সরে এসে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি সড়কে। হয়তো বা কখনও দাতাগোষ্ঠীর চাপে আবার কখনও রাজনৈতিক বা জনসাধারণের প্রত্যাশার ওপর ভিত্তি করে। এর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এককেন্দ্রিক হয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশের প্রেক্ষাপটে ৮৪ শতাংশ যাত্রী পরিবহন হয় সড়কপথেই। আর ৮৮ শতাংশ পণ্য পরিবহন হয় সড়কে। ফলে চাপটাও বেশি পড়ে, ভোগান্তিও বাড়ে। তাই আমাদের যোগাযোগের সব পথকে কাজে লাগিয়ে টেকসই উন্নয়ন করতে হবে। আর টেকসই উন্নয়ন করতে হলে উন্নয়নের ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
সমন্বিত পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নে কিছু ‘বেসিক গ্রামার’ পালন করতে হবে। আমাদের গতানুগতিক উন্নয়ন হচ্ছে, আমাদের উন্নয়ন টেকসই করতে হবে। বাইরে থেকে আমরা পরামর্শক আনি। কিন্তু আমি মনে করি তাদের দিয়ে আমাদের টেকসই উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। আমাদের দেশের মানুষ দিয়েই টেকসই উন্নয়ন করা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বর্তমান উন্নয়নের যে গতি প্রকৃতি দেখছি, সেটিকে আধুনিক বলতে অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। অমাদের রাস্তার কোনো ঘাটতি নেই। একে মোটা-তাজা করার কোনো দরকার নেই। আমরা মোড়ে গিয়ে আটকে যাচ্ছি যানজট হচ্ছেÑএ সমস্যার সমাধান আগে করতে হবে। অযথা লেন বাড়ালে আরও যানজট বাড়বে। এ সময় তিনি উল্লেখ করেন, প্রকল্পের অধিকাংশ কাজ করা হয় সমীক্ষা যাচাই করা ছাড়াই।
ড. শামছুল হক বলেন, আমাদের ব্যবসাবান্ধব অবকাঠামোর জন্য ঢাকা চিটাগং করিডোরটা হলো বাণিজ্যিক করিডোর। ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ এই গেটওয়ে দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমরা ব্যবসা বাণিজ্য করি। ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে করার জন্য সব সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু কোনো একটা কারণে তা আটকে গেল। হয়তো সরকার চিন্তা করেছিলেন যে, এ রুটে হাইস্পিড ট্রেন করবে। যখন দেখলাম তারা হাইস্পিড ট্রেন করবে, তখন এই এক্সপ্রেসওয়ে করার সিদ্ধান্ত বাদ দিল। এটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি। কারণ ট্রেন পণ্য পরিবহনের জন্য বিকল্প হতে পারে না। ট্রেন দিয়ে হয়তো যাত্রীসুবিধা আনতে পারব।
তিনি আরও বলেন, সামনে আমরা এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন করতে যাচ্ছি। আগে আমাদের অর্থনীতি নিরাপদ ছিল। কিন্তু ২০২৬ সালের পর আমরা সেই নিরাপত্তা পাব না। আমরা ধীরে ধীরে ভারী অর্থনীতির দিকে যাচ্ছি। আমাদের নিজেদের সক্ষমতা দিয়েই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে টিকে থাকতে হবে। তাই আমি বলব ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ের সেই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে বাণিজ্যের সুবিধার জন্য।
সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, আমরা উন্নয়ন করছি কিন্তু এই উন্নয়নে কোনো সমন্বয় আছে কিনা তা বড় প্রশ্ন। আমাদের সড়কের উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীতেই কোনো সিগনাল বাতি জ্বলছে না। তার অন্যতম কারণ হলো সমন্বয়ের অভাব। পৃথিবীর কোনো রাজধানী নেই, যেখানে লক্কড়ঝক্কড় বাস চলে। কিন্তু আমাদের এখানে তা হয়। সড়কে একই কোম্পানির বাস বেশি আয়ের জন্য রেস করে মানুষকে পিষে দিয়ে যায়। সিটি করপোরেশন সবসময়ই শহরের কোনো না কোনো রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি করতে থাকে।
তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রীয় বাস বিআরটিসি দেখবেন হাইকোর্ট, কার্জন হলে দিনে দুটি ট্রিপ মেরে ঘুমিয়ে থাকে। আর জনসাধারণ পরিবহন সংকটে ভোগে। এগুলো সব সমন্বয়ের অভাব। তিনি আরও বলেন, আমার খুবই ভাগ্যবান যে, আমাদের রাজধানীতে চারটি নদী আছে। কিন্তু সমন্বয় আর সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আমরা সেই নদীগুলোকে কাজে লাগাতে পারলাম না। এখন নদীগুলোকে আমরা ব্যবহার করছি ময়লা ও কারখানার বর্জ্য ফেলার স্থান হিসেবে। অথচ চাইলে এসব নদীগুলোকে ব্যবহার করে যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও উন্নয়ন করা যেত।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আমরা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার সঙ্গে উন্নয়নকাজ করে যাচ্ছি। বিশেষ করে অবকাঠামো ও সড়ক উন্নয়নের কাজগুলো। আপনাদের কাজে জনগণের আগ্রহ আছে। মানুষ চায় আপনাদের কাজগুলো দ্রুত করা হোক। প্রধানমন্ত্রীরও আপনাদের কাজে আগ্রহ আছে। তিনি একনেকে প্রকল্প উঠলেই তা পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে পাস করে দেন। আমরা আপনাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে চাই। উন্নয়ন করতে চাই, আমরা আপনাদের বন্ধু।
সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, অলোচনায় অনেকগুলো বিষয় উঠে এসেছে। আমাদের অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। সে বিষয়গুলো নিয়ে আমরা সঠিকভাবে কাজ করব। বিআরটিসি বাসগুলোর প্রতি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষ চাহিদা আছে। তাই আমাদের কিছু বাস তাদের দিতে হয়; বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের আয়োজনে অন্যান্যের মধ্যে আরও বক্তব্য দেন কূটনীতিক মাসফি বিনতে শামস, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর প্রমুখ।