কাজী সালমা সুলতানা: ২০ ডিসেম্বর, ১৯৭১। এদিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, তার চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান এবং নিরাপত্তা সচিব মেজর জেনারেল গোলাম উমর খানসহ কয়েকজন পদস্থ পাকিস্তানি কর্মকর্তাকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর দেয়া হয়। এদিকে মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী কুষ্টিয়া ও যশোর সফর করে বলেন, দেশ পাকিস্তানের কাছ থেকে মুক্ত করেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়নি। দেশের জনগণের হাতে স্বাধীনতার সুফল পৌঁছে দিতে হবে। শিগগিরই দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হবে। জুলফিকার আলি ভুট্টো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে সরাসরি প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে পৌঁছেন। ঘণ্টা দুই পর ঘোষণা দেয়া হয়, ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের শপথ নিয়েছেন। এক রেডিও ভাষণে বললেন, পূর্বাঞ্চলের পরাজয় তিনি মেনে নেবেন না। তিনি সামরিক বিপর্যস্তের প্রতিশোধ নেবেন। তিনি দম্ভ সহকারে বলেন, আমরা পূর্ব পাকিস্তান ফিরে পেতে লড়াই করব। এদিন ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণদণ্ড কার্যকর করতে চেয়ে ভুট্টোর মতামত চান। ভুট্টো বলেন, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা আর দেশে ফিরতে পারবে না।
এদিন নাটোরে অবস্থিত ৯ হাজার পাকিস্তানি সেনা মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করে। বগুড়া, হিলি, কুষ্টিয়া, ঈশ্বরদী, রাজশাহী থেকে আসা হানাদার পাকিস্তানি সেনা কমান্ডার মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহর নেতৃত্বে মিত্রবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল লছমন সিংহ ও ব্রিগেডিয়ার পানুর কাছে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করে। নাটোরে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে এদিন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়।
মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত কমান্ডের কাছে এদিন পাকিস্তানি হানাদার সেনারা নওগাঁ আত্মসমর্পণ করে। উল্লেখ্য, ১৩ থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা নওগাঁ শহর ঘেরাও করে রেখেছিল। পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ বার্তা মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠান। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ভীতি হানাদার সেনাদের সাহস হয়নি, পরে তারা মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ২০ ডিসেম্বর লন্ডনে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসে ইকোনমিক মিনিস্টার পদে নিয়োজিত এএফএম আহসানুল কবির বাংলাদেশের পক্ষে যোগ দিয়েছেন বলে ঘোষণা করেন। প্যারিদাস থেকে প্রাপ্ত এক সংবাদে বলা হয়, স্থানীয় পাকিস্তানি দূতাবাসে কমার্শিয়াল কাউন্সিলর পদে নিয়োজিত মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ এবং ব্রাসেলসে অবস্থিত পাকিস্তানি দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি পদে নিয়োজিত খায়রুল আনাম বাংলাদেশের পক্ষে যোগ দিয়েছেন। জাকার্তা থেকে প্রাপ্ত এক খবরে বলা হয়, স্থানীয় পাকিস্তান দূতাবাসে নিয়োজিত পাকিস্তানি অফিসাররা একযোগে পদত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যোগ দেয়। এদিন আনন্দবাজার পত্রিকা লেখে, নুরুল আমিন বলতে বাধ্য হলেন শেখ মুজিবকে জেলে রাখা যুক্তিহীন।
এদিকে আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজিকে আজ বিশেষ বিমানযোগে ঢাকা থেকে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয়। তার সঙ্গে যায় আরেক বন্দি, সাবেক গভর্নরের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি।
ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের মুখপাত্র জানান, গত রাত পর্যন্ত আটক পাকিস্তানি সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৫ হাজার ৬৭০। এর সঙ্গে যোগ করতে হয় চট্টগ্রাম গ্যারিসনে আটক আট হাজার সৈনিক। তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানি আমলা-কর্মচারী, পুলিশ প্রভৃতি ২০ হাজার জনকে এক মাসের মধ্যে ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে।
বিজয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করতে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর জড়ো হন মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু আকস্মিক এক মাইন বিস্ফোরণে সেদিন মারা যান মুক্তিযোদ্ধারা। সদ্য যুদ্ধজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের দেহ টুকরো টুকরো হয়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। জানা যায়, এই ক্যাম্পের অধিকাংশই ছিলেন গেরিলা বাহিনীর সদস্য। এলাকাবাসী ছিন্নভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের দেহ একত্র করে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে সমাধিস্থ করেন। সেই থেকে ২০ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের স্থানীয় শহিদ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
যাদের নাম পাওয়া গেছে, তারা হলেন শহিদ সুলেমান মিয়া, শহিদ রহিম বক্স খোকা, শহিদ ইয়ানুর আলী, শহিদ আছকর আলী, শহিদ জহির মিয়া, শহিদ ইব্রাহিম আলী, শহিদ আব্দুল আজিজ, শহিদ প্রদীপ চন্দ্র দাস, শহিদ শিশির রঞ্জন দেব, শহিদ সত্যেন্দ্র দাস, শহিদ অরুন দত্ত, শহিদ দিলীপ দেব, শহিদ সনাতন সিংহ, শহিদ নন্দলাল বাউরী, শহিদ কাজল পাল, শহিদ হিমাংশু কর, শহিদ জিতেন্দ্র চন্দ্র দেব, শহিদ আব্দুল আলী, শহিদ নুরুল ইসলাম, শহিদ মোস্তফা কামাল, শহিদ আশুতোষ দেব, শহিদ তরণী দেব, শহিদ নরেশ চন্দ্র ধর প্রমুখ।
এদিন জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম পার্টি, পিপিপি, পিডিপি, মুসলিম লীগের সব দল নিষিদ্ধ করা হয়।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও মূলধারা ৭১