সড়কে ধীরগতির সংস্কার প্রসঙ্গে

খরগোশ ও কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতার কথা অনেকেরই জানা। শেষ পর্যন্ত কচ্ছপেরই জয় হয়েছিল তার অনবরত ধীরগতির কারণে। দ্রুতগতির খরগোশ হার মানতে বাধ্য হয় ঘুমিয়ে কাটানোয়।

রাজধানী ঢাকা এখন বিশ্বের অন্যতম যানজটের শহর। যানজট ছাড়া সপ্তাহের একটি দিনও কল্পনা করা যায় না। ঘর থেকে বের হয়ে নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর কোনো নিশ্চয়তা নেই। শহরে যারা প্রতিদিন চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, পড়ালেখার জন্য বের হন, তাদের জীবনের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হয় শুধু যানজটে আটকা পড়ার কারণে। যানজট এতই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে যে, ছুটির দিনে বাইরে রেরুলেও যানজটের কবলে পড়তে হচ্ছে। যানজট এই ঢাকা নগরীর মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে দিনকে দিন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোথাও যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছেন কেউ কেউ।

সড়কপথে যখন সড়ক ব্যবহারকারী যানবাহনের সংখ্যা সড়কের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায়, তখন যানবাহনগুলো স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারে না, এরকম অবস্থাকে যানজট বলে। যানজট সমস্যা আমাদের দেশে নতুন কোনো সমস্যা নয়। এমন কোনো খাত নেই, যেখানে যানজটের কারণে ক্ষতি হয়নি। অসহনীয় যানজট কমিয়ে দিয়েছে ঢাকা শহরের মানুষের কর্মক্ষমতা।  যানজটে মানুষের শারীরিক ও মানসিক, কী পরিমাণ ক্ষতি হয় তা ইতোমধ্যে বিভিন্ন জরিপে প্রকাশিত হয়েছে। পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, যানজটে প্রতিদিন মানুষের ৫০ লাখ বা তার বেশি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। এই শ্রমঘণ্টার মূল্য বছরে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। উৎপাদন, স্বাস্থ্য ও দুর্ঘটনার ক্ষতি হিসাব করলে এর পরিমাণ হবে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। কয়েক বছর আগে বিনিয়োগ বোর্ডের গবেষণা প্রতিবেদনে যানজটের ক্ষতির খাতওয়ারি এক হিসাব দেখানো হয়েছিল। তাতে দেখানো হয়, যানজটের কারণে কর্মজীবী মানুষের বছরে যে পরিমাণ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় তার আর্থিক মূল্য ৪৩ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। উৎপাদন খাতে এ ক্ষতির পরিমাণ ৩০ হাজার ৬৮২ কোটি, স্বাস্থ্যগত ক্ষতি ২১ হাজার ৯১৮ কোটি, জ্বালানি ও মেরামত বাবদ ১ হাজার ৩৯৩ কোটি এবং দুর্ঘটনায় ক্ষতি হয় ১৫৪ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যানজটের কারণে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি’র ক্ষতির পরিমাণ ৭ শতাংশ। এখন যে তা আরও ছাড়িয়ে গেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যানজটের এই আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি স্বাস্থ্যগত ক্ষতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। যানজট ৯ ধরনের মানবিক আচরণকে প্রভাবিত করছে। দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব থেকে শুরু করে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মতো বিষয়গুলো যানজটে প্রভাবিত হচ্ছে।

ঢাকা শহরে যানজটের কারণে আর্থিক ক্ষতির এই হিসাব যাদের আকর্ষণ করছে না, তাদের জন্য আরেকটি তথ্য আছে। এই শহরে এখন ঘণ্টায় গড়ে প্রায় ৭ কিলোমিটার গতিতে চলছে যানবাহন।

বিশ্বের ৩৬টি মেগাসিটির মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৬। শহরটি মেগাসিটির অন্তর্ভুক্ত হলেও এটি পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। একটি আদর্শ শহরে যান চলাচলের জন্য শতকরা ২৫ ভাগ সড়ক প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকার আছে মাত্র ৮ ভাগ। এর মধ্যে শতকরা ৪৪ ভাগ সড়কে ফুটপাত নেই, ৮২ ভাগ ফুটপাতের অবস্থা করুন। যানজটের আর্থিক ক্ষতির হিসেবের মধ্যে সময়ের অপচয়, দেরির কারণে আনুষঙ্গিক ব্যয় বৃদ্ধি, পরিবেশগত ক্ষতি ও দুর্ঘটনার কারণে জীবনহানি ও পঙ্গুত্ববরণের বিষয়গুলো উল্লেখ করতেই হয়। যানজটের কারণে মানুষের অনেক মূল্যবান সময় রাস্তায় বসে বসে কেটে যায়। হয়তো এ সময়কে কাজে লাগিয়ে তারা জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারতেন। উন্নত বিশ্বের নাগরিকদের তুলনায় আমরা যে সবক্ষেত্রে পিছিয়ে আছি তার অন্যতম প্রধান কারণ এই যানজট। যানজট মানুষের মাঝে স্ট্রেস সৃষ্টি করে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় মালামাল পরিবহনে বিঘœ ঘটে, পরিবহন ব্যয় বেড়ে যায় এই যানজটের কারণে। এর কোনো সরকারই যানজটের অভিশাপ দূর করার ব্যাপারে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট তা বলা যায় না। প্রকল্পের পর প্রকল্প আসে, অনেক টাকা ব্যয় হয়, কিন্তু সমস্যার তিমির আর দূর হয় না। শুধু ফ্লাইওভার বা উড়াল সড়ক বা সাবওয়ে করে যানজটের সমাধান হবে না। ঢাকায় গণপরিবহন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। ব্যক্তিগত পরিবহনই সর্বেসর্বা। বাসের চেয়ে এখন সাধারণ প্রাইভেটকারই রাস্তাজুড়ে দখল করে থাকে সবসময়। বেশিরভাগ প্রাইভেটকারে অনেক সময় চালক ছাড়া আর কোনো যাত্রী থাকে না। একজন যাত্রী নিয়ে প্রাইভেটকার রাস্তার অনেকটা অংশ দখল করে থাকে। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকায় ১৫ শতাংশ যাত্রী দখল করে আছেন মোট সড়কের ৭০ শতাংশ। বর্তমানে ঢাকায় কমবেশি ১৫ শতাংশ যাত্রী প্রাইভেট গাড়িতে যাতায়াত করেন। এই প্রাইভেটকারের দখলে থাকে ৭০ শতাংশেরও বেশি রাস্তা। ৮৫ শতাংশ যাত্রী অন্য কোনো ধরনের গণপরিবহন ব্যবহার করেন। অর্থাৎ তারা গণপরিবহন সড়কের মাত্র ৩০ শতাংশ এলাকা ব্যবহারের সুযোগ পান।

ঢাকার যানজট কমাতে সর্বোপরি ঢাকা থেকে জনসংখ্যার চাপ কমাতে হবে। এর জন্য বিকেন্দ্রীকরণ, অর্থাৎ সারাদেশে সুষমভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানার বিস্তার ঘটাতে হবে। ঢাকায় সড়ক ও ভূমি ব্যবস্থাপনায় নৈরাজ্য ও দুর্নীতি কমাতে হবে। ব্যক্তিগত পরিবহন ব্যবহারে কড়াকড়ি আইন প্রয়োগ করতে হবে। সবাইকে এটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে যে, যানজট শুধু আমাদের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে তা নয়। আমাদের সবার জীবনকে নিরানন্দময়, বিষাক্ত ও ক্লান্তিকর করে তুলছে। এ অবস্থা বেশিদিন থাকলে ঢাকা শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব যানজটের অবসান ঘটাতে হবে।

মো. আল-মামুন
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০