সেলিম আহমেদ: একটা সময় ছিল ভোট মানেই উৎসব। যে কোনো ভোট এলেই আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠত মানুষ। সময় পাল্টেছে। এখন ভোট আসে, ভোট যায় কিন্তু উৎসব হয় না। এখন ভোট মানেই যুদ্ধ, একক আধিপত্য বিস্তার, বিজয় ছিনিয়ে নিতে কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, প্রতিপক্ষকে মাঠে নামতে না দেয়া, সংঘাত-সংঘর্ষ, খুনোখুনি। চলমান ইউনিয়ন নির্বাচনেও দেখা মিলেছে এই চিত্রের। এবার দ্বিতীয় বারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে নিবন্ধিত ৩৯টি দলের মধ্যে অংশ নিচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ হাতেগোনা কয়েকটি দল। শক্তিশালী বিরোধীদল বিএনপিসহ প্রায় অন্তত ৩০টি দল বয়কট করেছে নির্বাচন। যার ফলে নির্বাচন অনেকটা প্রাণহীন। তবুও ভোটের মাঠে চলছে রক্তের হোলিখেলা। নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণ ঝরছে একের পর এক। ৬ ধাপের ভোটের ইতোমধ্যে শেষ হওয়া তিন ধাপের ভোটে এখন পর্যন্ত সহিংসতায় প্রাণ গেছে প্রায় অর্ধশত মানুষের। নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) শতচেষ্টায়ও রোধ করা যাচ্ছে না সহিংসতা। ক্রমেই যেন তা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠছে। এছাড়া এবারের ইউপি নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে।
তথ্যমতে, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত নির্বাচনী সহিংসতায় মারা গেছেন ৯২ জন। ডিসেম্বরের এই ক’দিনে আরও ৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সবমিলিয়ে নির্বাচনী সহিংসতায় লাশের সারি দীর্ঘ হয়ে শতকের কোঠায় এসে পৌঁছেছে। গুরুতর আহত হয়েছেন সহস্রাধিক। আর বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা সংস্কৃতি ফোরাম (এমএসএফ) দাবি করছে, গত নভেম্বর মাসে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাকেন্দ্রিক ৯৮টি নির্বাচনী সহিংসতায় কমপক্ষে ৪৭ জন নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ৭৮ জন। এসব সহিংসতায় আহত হয়েছেন ৫০০-এর বেশি মানুষ।
অন্যদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতেও প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমছে। বিনা ভোটে বিজয়ী হওয়া যেন অনেকটাই রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে তৃণমূলের মূল ভিত্তি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চলমান নির্বাচনেও। ধারাবাহিক নির্বাচনের পাঁচ ধাপে দেড় হাজারেরও বেশি জনপ্রতিনিধি বিনা ভোটেই বিজয়ী হয়ে গেছেন। এবারের ইউপি নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। ইসির তথ্যমতে, চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এ পর্যন্ত তিনটি ধাপের ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ২৬ ডিসেম্বর চতুর্থ ধাপের ভোটগ্রহণ হবে। আর পঞ্চম ধাপের ভোট হবে ৫ জানুয়ারি। চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা সমন্বয় করে ইসির প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাঁচ ধাপে তিন হাজার ৭৫৩টি ইউপির মধ্যে এক হাজার ৬০০ প্রার্থী ভোট ছাড়াই বিজয়ী হয়েছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৩৫৪ জন, সাধারণ সদস্যপদে ৮৫৮ এবং সংরক্ষিত নারী সদস্য ৩৬৪ জন। আগামী ৩১ জানুয়ারি ষষ্ঠ ধাপে আরও ২১৯টি ইউপির ভোট অনুষ্ঠিত হবে। যার মনোনয়নপত্র জমা ও প্রত্যাহারের সময় এখনও পার হয়নি। চেয়ারম্যান পদে ভোট ছাড়া বিজয়ী ৩৫৩ প্রার্থীর মধ্যে ৩৫২ জনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ইসি সংশ্লিষ্টরা।
এই দলীয় প্রতীকে নির্বাচনই ‘বিষফোঁড়া’ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে অভিজ্ঞমহলের অভিমত। তারা বলছেন, যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার পাঁচ বছর আগে আইন করে ইউপিসহ সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার ব্যবস্থা করেছিলÑতা সফলতা বয়ে আনার পরিবর্তে সরকারের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে।
চলমান ইউপি নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ও কোন্দল-গ্রুপিং ও প্রাণহানির কারণে সরকারের সকল অর্জন প্রশ্নের মুখোমুখি। ইউপি হচ্ছে স্থানীয় সরকারের একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের নির্বাচন। তাই এ নির্বাচন কেন্দ্র করে প্রতিটি গ্রামপর্যায়ে এমনকি পাড়া-মহল্লার মানুষ বেশি তৎপর থাকে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য সবাই চায় তাদের পছন্দের মানুষটি যেন ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আর এতেই বিপত্তি ঘটে। বিশেষ করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় এবং বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন দলগতভাবে বর্জন করায় সরকারি দল আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা যারা পাচ্ছেন, তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা।
আবার দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় অনেক ভালো প্রার্থী এখন আর নির্বাচন করতে চান না। আর বিভিন্নভাবে লবিং ও অর্থ খরচ করতে না পারায় অনেক সময় তৃণমূলের ভালো প্রার্থীরা দল থেকে মনোনয়ন পাচ্ছে না। তাই তারা হতাশ হয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। এর ফলে অপর সব দুর্বল প্রার্থীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ বেড়ে গেছে।
নির্বাচনের সময় সংশ্লিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো থাকে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু এত সহিংসতা ঘটলেও তা সামাল দিতে খুব একটা তৎপর ছিল না ইসি। সহিংসতা সামাল না দিয়ে উল্টো দায় চাপাচ্ছে দলগুলোর ওপর। মেয়াদ ফুরিয়ে আসা নির্বাচন কমিশন কোনো দায় না নিয়ে ‘পাহারা দিয়ে সহিংসতা ঠেকানো যায় না’ বলে অনেকটা নিজেদের অসহায়ত্বই প্রকাশ করেছে। তবে সহিংসতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি প্রশাসনকে কাজে লাগাতে সরকারের কাছে লিখিতভাবে সহযোগিতা চেয়েছে সাংবিধানিক সংস্থাটি।
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি অনেকটা আস্থা হারিয়েছেন ভোটারা। যার ফলে বিগত বিভিন্ন সংসদ, সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌরসভাসহ বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ভোটার উপস্থিতি কম দেখা গেছে। ইউপি নির্বাচনেও এভাবে সংঘাত, ভোট কারচুপি ও বিনা ভোটে বিজয়ী হওয়ার বিষয়টি চলমান থাকায় ভোটের প্রতি মানুষের অনাস্থা আরও বাড়ছে; যা গণতান্ত্রিক অবস্থার জন্য হতে পারে অশনিসংকেত।
সাংবাদিক
selimnews18@gmail.com