ঢাকা ডায়িংয়ের শেয়ারে বছরজুড়ে কারসাজি!

মো. আসাদুজ্জামান নূর: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ঢাকা ডায়িংয়ের শেয়ার নিয়ে চলছে নানা কারসাজি। শেয়ারদরের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বমুখিতায় আকৃষ্ট হয়ে এ শেয়ারে বিনিয়োগ করেন অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। কিন্তু বাজার কারসাজিতে দুই মাসের ব্যবধানে শেয়ারপ্রতি ৯ টাকা লোকসান দিয়েছেন তারা। অনেকেই পুঁজি হারিয়েছেন, অনেকের বিনিয়োগ আটকে আছে।

২০২১ সালের শুরুতে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল সাত টাকা ৯০ পয়সা। বছরের শেষে ৩০ ডিসেম্বর সেটি হাতবদল হয়েছে ২৪ টাকা ১০ পয়সা। ফলে এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ২০৫ শতাংশের বেশি। তবে গত সেপ্টেম্বরে শেয়ারটির দাম ২৫৫ শতাংশের বেশি বেড়েছিল। এরপর পড়তে শুরু করে।

বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শেয়ারদরের এমন উল্লম্ফনে আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই বিনিয়োগ করেছিলেন ওই কোম্পানিতে। কিন্তু এরপরই আবার কমতে শুরু করে এর দর। ফলে অনেকেই পুঁজি হারিয়েছেন।

এদিকে শেয়ারটি নিয়ে একটি মহল কারসাজি করছে বলে জানা গেছে। বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে আবারও ফায়দা লুটার চেষ্টা করছে তারা। কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়ে ৪০ থেকে ৫০ টাকা ছাড়াবে বলে প্রচার করা হচ্ছে। ফলে জুয়াড়িদের কারসাজিতে ঝুলছে বিনিয়োগকারীদের ভাগ্য।

গত এক বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা, ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা ডায়িংয়ের প্রতিটি শেয়ার বিক্রি হয় সাত টাকা ৮০ পয়সায়। এরপর থেকে ক্রমাগত দর বাড়তে দেখা গেছে। ১ জুন শেয়ারের দাম ১৪ টাকা ৮০ পয়সায় উঠলে কোম্পানির কাছে অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির কারণ জানতে চায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। ৬ জুন কোম্পানির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের কাছে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই।

এরপরও শেয়ারের দাম বাড়তেই থাকে। ৯ আগস্ট ২৬ টাকা ৭০ পয়সায় ওঠে। আবারও দরবৃদ্ধির পেছনে কোনো কারণ আছে কি না জানতে চায় ডিএসই। এর উত্তরে একই তথ্য জানায় ঢাকা ডায়িং। এরপর আর লাগাম ধরা যায়নি শেয়ারদরের। কোনো কারণ ছাড়ায় ক্রমাগত দাম বাড়তে থাকে।

এদিকে কোম্পানির শেয়ারদর বাড়ানোর জন্য কোম্পানির পক্ষ থেকেও কিছু সস্তা কৌশলও খাটানো হয়েছে। ২ সেপ্টেম্বর বিনিয়োগকারীদের

এক শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করে কোম্পানিটি। এর ফলে ‘জেড’ ক্যাটেগরি থেকে ‘বি’ ক্যাটেগরিতে চলে আসে। ওই সময় পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছিলেন, এক শতাংশের নামমাত্র লভ্যাংশ প্রদান বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করার একটি প্রক্রিয়া মাত্র। এক শতাংশ লভ্যাংশ প্রদান করায় কোম্পানিটি লেনদেন ‘জেড’ ক্যাটেগরি থেকে ‘বি’ ক্যাটেগরিতে লেনদেন করবে। এতে প্রলুব্ধ হবেন বিনিয়োগকারী।

এছাড়া ওইদিন ক্যাটেগরি পরিবর্তনের ফলে ঢাকা ডায়িংয়ের শেয়ার কিনতে মার্জিন ঋণ প্রদানে নিষেধ করা হয়। মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারদের আগামী ৩০ কার্যদিবস কোম্পানির শেয়ার কিনতে মার্জিন লোন প্রদান থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। কিন্তু এতে দরবৃদ্ধি ঠেকানো যায়নি। এরপর সেপ্টেম্বরের ২১ তারিখে শেয়ারটি হাতবদল হয়েছে সর্বোচ্চ দামে। ওইদিন প্রতিটি শেয়ার বিক্রি হয় ২৮ টাকা ১০ পয়সায়।

তবে এরপরেই কমতে থাকে শেয়ারদর। ২২ ডিসেম্বর সেটি কমে ১৯ টাকা ১০ পয়সায় বিক্রি হয়। ফলে সর্বোচ্চ দামে যেসব বিনিয়োগকারী শেয়ার কিনেছিলেন, এ সময়ের মধ্যে তারা প্রতিটি শেয়ারে লোকসান গুনেছেন ৯ টাকা। তবে এরপর আবারও শেয়ারদর বাড়তে দেখা গেছে। এমনকি দুই কোম্পানি হল্টেড হতেও দেখা গেছে। সর্বশেষ ৩০ ডিসেম্বর ২৪ টাকা ১০ পয়সায় হাতবদল হয়েছে শেয়ারটি।

এদিকে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ও বিনিয়োগকারী সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা ডায়িংয়ের শেয়ার নিয়ে আবারও কারসাজি শুরু হচ্ছে। খুব শিগগিরই কোম্পানির শেয়ারদর দ্বিগুণ হারে বাড়বে। প্রতিটি শেয়ারের দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকা ছাড়াবে।

কিন্তু কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে এই দাম কোনোভাবেই যৌক্তিক নয় বলে জানিয়েছেন পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরা। ডিএসইর তথ্যমতে, ২০০৯ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ঢাকা ডায়িংয়ের ঋণের পরিমাণ এর পরিশোধিত মূলধনের চেয়েও বেশি। ৩০০ কোটি টাকার অনুমোদিত মূলধনের বিপরীতে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন ৮৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এর বিপরীতে কোম্পানিটির ঋণের পরিমাণ ১২৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১২৫ কোটি ২০ লাখ টাকা স্বল্প মেয়াদে ও এক কোটি ৬৮ লাখ টাকা দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ রয়েছে।

ডিএসইর তথ্য বলছে, ২০২০ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই বছরে কোম্পানিটি এক কোটি ১৫ লাখ টাকা মুনাফা করেছে। যদিও এর আগের বছরগুলোয় ধারাবাহিক লোকসান দিয়েছে কোম্পানিটি। এছাড়া আলোচিত সময়ে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে আট টাকা ৩৬ পয়সায়। যার তুলনায় বর্তমান শেয়ারের মূল্য কয়েকগুণ বেশি।

এদিকে কোম্পানির মোট শেয়ারের মাত্র ৩০ শতাংশ রয়েছে পরিচালকদের হাতে। বাকি ৭০ শতাংশ শেয়ারের ৫৩ দশমিক ০৭ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারী, শূন্য দশমিক ৩৮ শতাংশ বিদেশি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ১৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ শেয়ার।

ঢাকা ডায়িংয়ের শেয়ার নিয়ে শুরু থেকেই কারসাজি হচ্ছে বলে মত দেন বিনিয়োগকারী ফিদুল বিশ্বাস। তিনি বলেন, এটি একটি গ্যাম্বলিং শেয়ার। গ্যাম্বলিংয়ের মাধ্যমে শেয়ারটির দর তোলা হয়েছিল। আবারও শেয়ারদর বাড়ার গুঞ্জন তুলে পাবলিককে গেলানো হবে। তারপর গ্যাম্বলাররা মার্কেট থেকে বেরিয়ে যাবে। লোকসানে পড়বেন সাধারণ বিনিয়োগকারী।

ঢাকা ডায়িংসহ অন্যান্য কোম্পানির এমন অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ডিএসইর কার্যক্রম শুধু কারণ দর্শানোর নোটিসেই সীমাবদ্ধ থাকবে কিনা জানতে চাইলে ডিএসইর প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) সাইফুর রহমান মজুমদার বলেন, কোনো কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়লে ডিএসই তা পর্যবেক্ষণ করে। দরবৃদ্ধির কারণ জানতে চাওয়া হয়। শেয়ারদর বাড়ার পেছনে মূল্য সংবেদনশীল তথ্য (পিএসআই) আড়াল করলে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম হবে না। তিনি ঢাকা ডায়িংয়ের বিষয়ে খোঁজখবর নেবেন বলে জানান।

তিনি আর বলেন, ভবিষ্যতে মূল্য সংবেদনশীল তথ্যের বিষয়ে ডিএসইর পদক্ষেপ আরও কঠোর হতে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় দেখা যায়, অনেক কোম্পানি অ্যাকশনধর্মী পিএসআই ঘোষণা করে। যেমন জমি কেনা, ব্যবসা সম্প্রসারণ ইত্যাদি। এতে শেয়ারদর বাড়ে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, সেটা তদারকি জরুরি। আগামীতে এ ধরনের পিএসআই ইস্যুতে ডিএসইর নজরদারি আরও বাড়ানো হবে। ইতিবাচক বা নেতিবাচক, দুই ধরনের মূল্য সংবেদনশীল তথ্যের বিষয়েই ডিএসইর পদক্ষেপ ভবিষ্যতে আরও দৃঢ় হতে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। এ বিষয়ে কথা বলতে ঢাকা ডায়িংয়ের অফিসিয়াল টেলিফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলেও সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০