নেতৃত্বের সংকটে ডুবছে উসমানিয়া গ্লাস ফ্যাক্টরি

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশের প্রথম গ্লাস উৎপাদনকারী কারখানা উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি লিমিটেড। ৬২ বছর বয়সী এ কোম্পানি একদিকে পুরোনো প্রযুক্তির কারখানা, দুটি উৎপাদন ইউনিটের একটি বন্ধ, উৎপাদন ব্যয় বেশি, বাজারের অসম প্রতিযোগিতা, নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতা, অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে গত পাঁচ বছরে লোকসান করেছে ৪৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

অন্যদিকে নেতৃত্ব, বিনিয়োগ ও উদ্যোগের অভাবে প্রতিনিয়ত ডুবছে উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি। ফলে গত পাঁচ বছর ফ্যাক্টরি বড় ধরনের আর্থিক সংকটের থাকার এফডিআর (স্থায়ী আমানত) ভেঙে ফেলতে হয়। পাশাপাশি করোনার প্রভাবে বিক্রয় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠান নিয়ে চরম হতাশায় আছেন বিনিয়োগকারীরা।

উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি লিমিটেড সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত পুরোনো প্রযুক্তি ও জরাজীর্ণ পুরোনো যন্ত্রপাতি দ্বারা শুধু সাদা রঙের গ্লাস শিট উৎপাদন করে উসমানিয়া। এর মধ্যে তিন বছরের ধরে বন্ধ আছে এক নাম্বার ফার্নেস ইউনিট। আর এক বছর বন্ধ থাকা দুই নম্বর মেশিনটি (ইউনিট) কয়েক মাস আগে চালু হয়েছে। ফলে গত ২০২০-২১ অর্থবছরের গ্লাস উৎপাদন করতে পারেনি। এছাড়া করোনার প্রভাবে কাচ বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরের নিট লোকসানের পরিমাণ ১০ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এর আগের অর্থবছরের লোকসান ১২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১২ কোটি ৮২ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের দুই কোটি ৩৮ লাখ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সাত কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে গত পাঁচ বছরের ৪৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা লোকসান করে। আর লোকসানে ধারা অব্যাহত আছে।

অন্যদিকে প্রতিযোগীদের তুলনায় পুরোনো প্রযুক্তিতে গ্লাস শিট উৎপাদন করে উসমানিয়া গ্লাস শিট। এতে পণ্যের মান নি¤œমানের হলেও উৎপাদনে ব্যয় বেশি। ফলে প্রতিযোগী কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত মূল্য কমানোর প্রতিযোগিতা থাকার কারণে কয়েক বছর ধরে লোকসানে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। বিক্রয় কম, চাহিদা কম এবং মজুদ বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিটির উৎপাদন সক্ষমতার ৫০ শতাংশও ব্যবহার করতে পারছে না। আর তারল্য সংকটের পাশাপাশি উসমানিয়া গ্লাস শিটের ফ্যাক্টরি উৎপাদনে বড় ধরনের প্রযুক্তিগত সমস্যায় ভুগছে। এছাড়া কনটেইনার গ্লাস প্লান্ট অর্থাৎ আধুনিক একটি ইউনিটের পরিকল্পনা থাকলেও দুর্বল ব্যবস্থাপনা বিশদ বর্ণনা করতে পারেনি। এর জন্য জমি ও অর্থের প্রয়োজন তাও উল্লেখ করতে পারেনি।

প্রতিষ্ঠানটির প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন হিসাব অনুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরের মোট বিক্রয় ছিল মাত্র তিন কোটি ৫১ লাখ টাকা। কিন্তু বিক্রীত পণ্যের ব্যয়, বিক্রয়-বিপণন ব্যয়, প্রশাসনিক ব্যয়সহ সব ধরনের খরচ নির্বাহ করার পর নিট লোকসান হয়েছে ১০ কোটি ৬২ লাখ টাকা। এতে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ছয় টাকা ৬৬ পয়সা। এ কারণে গত অর্থবছরের শেয়ারহোল্ডাদের কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। এ নিয়ে টানা তিন বছর কোনো লভ্যাংশ দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি।

অন্যদিকে খান ওহাব শফিক রহমান অ্যান্ড কোং তাদের নিরীক্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ২০২০-২১ হিসাববছর শেষে কোম্পানিটির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা। নগদ তারল্য সংকট কাটাতে না পারলে নতুন ও উন্নত প্রযুক্তির মেশিনারিজ ইনস্টল অসম্ভব। এতে কোম্পানির ভবিষ্যতে ব্যবসা পরিচালনা করার সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ আছে। আর তারল্য সংকটের পাশাপাশি উসমানিয়া গ্লাস শিটের ফ্যাক্টরি উৎপাদনে বড় ধরনের প্রযুক্তিগত সমস্যায় ভুগছে। এছাড়া কনটেইনার গ্লাস প্লান্ট অর্থাৎ আধুনিক একটি ইউনিটের পরিকল্পনার ফিজিবিটি স্টাডি কাজ সেøা বলে উল্লেখ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ৬০ বছরের পুরোনো প্রযুক্তি ও জরাজীর্ণ যন্ত্রপাতি দ্বারা গ্লাস শিট উৎপাদন, বাজারের অসম প্রতিযোগিতা, কাঁচামাল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, বিক্রয় কমিশন বৃদ্ধি এবং গ্লাসের চাহিদা কমে যাওয়ায় উসমানিয়া লোকসানে ছিল। পাশাপাশি আগুন ও করোনার প্রভাবে একেবারে তো উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেল। এর দায় নীতিনির্ধারকদের দীর্ঘ সময়ের অবহেলা। কিছুদিন আগে কয়েকজন কর্মকর্তাকে অন্যদিকে পদায়ন করা হয়। এখন যেহেতু ২০২০-২১ অর্থবছরের উৎপাদন এবং বিক্রয় বন্ধ ছিল। ফলে লোকসানের পাহাড় বাড়বে। এ প্রযুক্তিতে লাভ করা সম্ভব নয়, সেই সুযোগ নেই। হয়তো সরকারের বিকল্প চিন্তা আছে, যা আমরা জানি না। আর প্রতিনিয়ত বেড়েছে দায়-দেনার পরিমাণ। এখন সরকার নগদ অর্থ এবং নতুন ও উন্নত প্রযুক্তির মেশিনারিজ ইনস্টল (স্থাপন) না করলে কোম্পানিটির পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।

প্রতিষ্ঠানটির একাধিক বিনিয়োগকারী বলেন, দীর্ঘদিনের অবহেলা এবং উদাসীনতার কারণে আজ উসমানিয়া গ্লাসের এ অবস্থা। চারদিকে এত উন্নয়ন হচ্ছে। অথচ উসমানিয়ার করুণদশা। এ করুণদশা থেকে উত্তরণের জন্য কোম্পানি সম্পূর্ণ ৯ দশমিক ৮ একর জমিসহ বেসরকারি খাতে অথবা পিপিপির মাধ্যমে আধুনিক কারিগরি ক্ষমতাসম্পন্ন করে সম্প্র্রসারণ করা যেতে পারে। তা না হলে এ কোম্পানির হারিয়ে যাবে। এ কোম্পানির শেয়ার গড়ে ১০০ টাকা করে কেনা। এখন ৬১ টাকা দর।

এ বিষয়ে জানতে উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আক্তারুজ্জামানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়। পরে কোম্পানির সচিব বিপ্লব কুমার মজুমদার শেয়ার বিজকে বলেন, কারখানার দুই নাম্বার ফার্নেসের উৎপাদন চলতি অর্থবছরের শুরুতে চালু হয়েছে। এখন উৎপাদন ও বিক্রয় হচ্ছে। যদিও করোনার প্রভাবে বিক্রয় কম হওয়ায় স্টক জমে আছে। আর নতুন ৪০০-৫০০ কোটি টাকার কনটেইনার গ্লাস ইউনিট করার জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি ও মার্কেট স্টাডি হয়েছে, যা আমাদের পরিচালকদের সভায় আলোচনা হয়েছে। সেখানে কিছু পর্যবেক্ষণ এসেছে। এরপর প্রকল্প ডিজাইন, মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন, অর্থায়নের উৎস ইত্যাদি নিশ্চিত হলে, তখন কাজ শুরু হওয়ার সুযোগ আছে। তবে কবে নাগাদ কাজ শুরু হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আর এ ধরনের প্রকল্পে তো অনেক সময় লাগে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০