নিজস্ব প্রতিবেদক: অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক সম্পদের অপরিকল্পিত ব্যবহার বাড়ছে। পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ু; বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। শঙ্কা তৈরি হচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের। আগামী প্রজন্মের জন্য জলবায়ু সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বর্জ্য ও পরিবেশ দূষণ রোধ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সার্কুলার ইকোনমি বা বৃত্তাকার অর্থনীতির বিকাশ অত্যন্ত জরুরি। বৃত্তাকার অর্থনৈতিক মডেলে উৎপাদন ও ভোগের মধ্য সমন্বয় সাধন হয়। পণ্য ব্যবহারের পর বর্জ্য সংরক্ষণ ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এর ফলে কার্বন নিঃসরণ কমে, দূষণের হাত থেকে রক্ষা পায় অর্থনীতি। তাই টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের কার্যকর হাতিয়ার হচ্ছে সার্কুলার ইকোনমি।
এফবিসিসিআই আয়োজিত ‘সার্কুলার অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি: সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে গতকাল এসব কথা বলেন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।
রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সেমিনারে সভাপতি বলেন, বিশ্বে এখন কেউ বর্জ্যকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে না। এক শিল্পের বর্জ্য অন্য শিল্পের জন্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন, ২০৩১ সাল নাগাদ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য রয়েছে বাংলাদেশের। এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আর সে জন্য সার্কুলার ইকোনমির বিকাশ অত্যন্ত জরুরি। দেশে নির্মাণ শিল্প, টেক্সটাইল, মোটর গাড়ি, লজিস্টিকস, কৃষি, আসবার, তেল ও গ্যাস, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতকে সার্কুলার ইকোনমিতে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার মাত্র সাত থেকে আট কেজি। যুক্তরাষ্ট্রে এ হার ১৩০ কেজি। পুনঃপ্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে প্লাস্টিক বর্জ্যকে পুনরায় সম্পদে রূপান্তর করছে দেশটি।
তিনি জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো সার্কুলার ইকোনমি প্রয়োগের ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে। ইউরোপীয় কমিশন এরই মধ্যে সার্কুলার ইকোনমি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেছে। এছাড়া চীন, ব্রাজিল, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান তাদের অর্থনীতিকে সার্কুলার ইকোনমিতে স্থানান্তরে কাজ করছে। বাংলাদেশেরও একই উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। তবে সে জন্য বর্জ্যকে ধরন অনুযায়ী আলাদা করে ফেলতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে আলাদা কোনো ডাম্পিং জোন নেই, যেখানে বর্জ্যকে আলাদা করা সম্ভব। এ জন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানান এফবিসিসিআই সভাপতি।
সেমিনারে প্রধান অতিথি শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, ‘সার্কুলার ইকোনমি নিয়ে কাজ করতে মন্ত্রণালয়ে একটি আলাদা সেল গঠন করা হবে। এই সেল সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংগঠনের সঙ্গে একত্রে কাজ করবে।’ সার্কুলার ইকোনমি বিকাশের জন্য অপরিহার্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প। দেশে অনানুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে অনেক কাজ হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন মন্ত্রী। এ খাতের আনুষ্ঠানিক শিল্পের মর্যাদা পাওয়া উচিত বলে মনে করেন শিল্পমন্ত্রী।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ুমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন আহমেদ জানান, বর্তমানে ৪০ শতাংশ প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। বাকি ৬০ শতাংশকেও এর আওতায় আনতে হবে। এজন্য প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ওয়ার্কিং পেপার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সুজাউদ্দিন।
প্যানেল আলোচনায় বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ইকোনমিক স্পেশালিস্ট ইয়ুন জু অ্যালিসন জি বলেন, গত ১০ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি খুবই প্রশংসনীয়। কিন্তু পরিবেশবান্ধব প্রবৃদ্ধির দিকে যাব কি নাÑএখন তা নির্ধারণ করার সময় এসেছে। কেননা সম্পদের অবক্ষয় শুধু আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি কিংবা প্রবৃদ্ধিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, বরং ভবিষ্যতকেও চরম ঝুঁকিতে ফেলবে। টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়, সরকারি সংস্থাগুলোর সক্ষমতা ও সচেতনতা বাড়াতে আরও বিনিয়োগ করা জরুরি বলে মনে করেন ইয়ুন জু অ্যালিসন জি। ভবিষ্যতে সার্কুলার ইকোনমি বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি।
এছাড়া প্যানেল আলোচনায় আরও অংশ নেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের উপপরিচালক অধ্যাপক ড. মিজার আর খান, এফবিসিসিআইয়ের উপদেষ্টা ও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক। তারা বলেন, সার্কুলার ইকোনমির সঠিক বাস্তবায়নে চাহিদা ও জোগানের সমন্বয়ের জন্য একাডেমিয়া ও শিল্প খাতের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করা প্রয়োজন।
সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেনÑএফবিসিসিআইর সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, সহসভাপতি মো. আমিন হেলালী, মো. হাবীব উল্লাহ ডনসহ অন্যান্য পরিচালক।