লুৎফর রহমান লাভলু: বাংলাদেশ বর্তমানে পৃথিবীর মানচিত্রে এক স্বাধীন, সার্বভৌম ও উন্নয়নকামী রাষ্ট্র। বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশের উন্নয়নে সবিশেষ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে শহরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চল। শহর ও গ্রাম এ দুটি স্তর নিয়েই আমাদের সোনার বাংলা। একটি দেশের শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলও আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। একটি রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণে যেমন দক্ষ নেতৃত্বের প্রয়োজন, তেমনি গ্রামীণ সমাজের সামাজিক প্রতিষ্ঠান গঠন, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে চাই দক্ষ ও ন্যায়বান গ্রামীণ নেতৃত্ব। গ্রামপ্রধান বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের সহজ-সরল ও নিরক্ষর মানুষকে সচেতন জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে তুলে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে এগিয়ে আসে গ্রামীণ নেতৃত্ব। গ্রামীণ জনগণ তাদের অসচেতনা ও অজ্ঞতার কারণে জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে গ্রামীণ নেতাদের দারস্থ হয় এবং তাদের সিদ্ধান্তের দ্বারা প্রভাবিত হয়। কিন্তু বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে একজন নেতা সামাজিক উন্নয়নে কতটুকু অবদান রাখে, তা আজ প্রশ্নসাপেক্ষ।
সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে দেখা যায়, গ্রামীণ উন্নয়নে একজন নেতা কার্যকর ও বহুমুখী ভূমিকা পালন করে। আধুনিক সমাজ বিনির্মাণে গ্রামীণ নেতৃত্বের সফলতা আলোচনা করা হলো ঐতিহ্যগতভাবেই গ্রামীণ জনগণ স্থানীয় নেতাকর্মীদের কথা মান্য করে। কারণ তারা গ্রামের মাথা বা বাবা-মা হিসেবে পরিচিত। ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষ কোনো সমস্যার পতিত হলে তারা গ্রামীণ নেতাদের কাছে পরামর্শ চায়। গ্রামীণ নেতৃত্ব সাধারণ জনগোষ্ঠীকে সুপরামর্শ দিয়ে এগিয়ে যায় এবং জনগণকে গতিশীল করে। গ্রামের সাধারণ মানুষ সাধারণত অজ্ঞ ও অসচেতন, আর গ্রামীণ নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবে শিক্ষিত ও সচেতন। তারা শিক্ষিত ও সচেতনার গুণাবলির দ্বারা গ্রামের সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করতে পারে। একটি জনগোষ্ঠী সীমাহীন সমস্যাকে অতিক্রম করে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। কাজেই গ্রামীণ অনগ্রসর একটি অংশকে সামাজিক সচেতনতায় এগিয়ে নিতে তারা বিশেষ ভূমিকা রাখে।
গ্রামীণ নেতৃত্ব সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে। কারণ সরকারের একার পক্ষে গ্রামীণ জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই সরকার ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে গ্রামীণ নেতৃত্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠায় গ্রামীণ উন্নয়নের পথ অনেকটা প্রশস্ত হয়। গ্রামীণ নেতৃত্ব উন্নয়নের নতুন মডেল ও কৌশল উদ্ভাবন করতে পারে। কারণ তারা বাস্তবতার মাঝে চলে গ্রামীণ সমাজে কখন কী কী করতে হবে, কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে গ্রামীণ উন্নয়ন সম্ভব এবং গ্রামবাসী উপকৃত হতে পারেÑএসব ক্ষেত্রে একমাত্র গ্রামীণ নেতৃত্বই সঠিকভাবে বুঝতে পারে। গ্রামীণ উন্নয়নে সময়োপযোগী, কার্যকর ও বাস্তবানুগ আদর্শ ও কৌশল গ্রহণ করে।
গ্রামীণ সমাজে আধুনিকায়ণে গ্রামীণ নেতৃত্বের অবদান রয়েছে; কারণ তারাই গ্রামের একমাত্র শিক্ষিত, জ্ঞানী ও সচেতন অংশ। সাধারণ মানুষকে আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে গ্রামীণ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে গ্রামীণ নেতৃত্ব। সারাদেশ সঠিকভাবে পরিচালনা করা সরকারের একার পক্ষে কখনও সম্ভব নয়। তাই সরকারি নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে গ্রামীণ নেতৃত্ব। একটা গ্রামীণ সমাজে কখন কী প্রয়োজন, সকল বিষয়ে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে গ্রামীণ নেতৃত্ব। একজন আদর্শবান গ্রামীণ নেতা সমাজকে ঢেলে সাজাতে যেমন পারে, তেমনি সমাজের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণেও সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে। যেমন: গ্রামের রাস্তাঘাট, কালভাট, ব্রিজ নির্মাণ, স্কুল, মাদরাসা, খেলার মাঠ সব সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ ও পুর্ণসংস্কারে এগিয়ে এসে গ্রামীণ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে গ্রামীণ নেতারা। অর্থাৎ তৃণমূল থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সার্বিকভাবে সহযোগিতা ও এগিয়ে নিতে আদর্শবান গ্রামীণ নেতৃত্বের বিকল্প নেই।
গ্রামপ্রধান এদেশে যদি প্রতিটি সমাজের গ্রামীণ উন্নয়ন সাধন করা যায়, তাহলে দেশব্যাপী উন্নয়নের জোয়ার ভাসবে, তবে তার জন্য ন্যায়নিষ্ঠবান নেতার প্রয়োজন। একটি মুদ্রার যেমন দুটি পিঠ থাকে, তেমনি বাংলাদেশের গ্রামীণ নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও তার বিপরীত নয়। একজন নেতা সমাজে যেমন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তেমনি চাইলে সে অবিচার করতে পারে। বাংলাদেশ গ্রামপ্রধান দেশ, তাই গ্রামীণ নেতৃত্বের সংখ্যাও অনেক। তবে একটা কথা হাজারো তিতা হলেও সত্য যে, এসব গ্রামীণ নেতৃত্ব গ্রামীণ উন্নয়নে ঠিক ততটা অবদান রাখে যতটা রাখা দরকার। যদি তা-ই হতো প্রতিবছর গ্রামীণ উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সরকার যে পরিমাণ বরাদ্দ দিয়ে থাকে, তার সঠিক ব্যবহার করলে গ্রামাঞ্চল আর শহরাঞ্চলের মাঝে এত পার্থক্য থাকত না।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানব উন্নয়ন, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যোগাযোগব্যবস্থা ও অবকাঠামোর কঙ্কালচিত্র সম্বন্ধে সবাই অবগত, কারণ তারা এসব বাজেট ও সরকারি অর্থায়নের বেশিরভাগ পকেটভর্তি করে থাকে। এর ফলে আজও গ্রাম ও শহরের আকাশ-পাতাল তফাত। গ্রামীণ সমাজে অনেক সময় ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি ও জমিজমা-সংক্রান্ত যে সমস্যাগুলো হয়, সেগুলো তারা মীমাংসা না করে আরও জটিল করে থাকে। এতে করে দুর্বলরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়, এমনকি অনেক সময় টাকা নিয়ে তারা সত্য গোপন করতেও দ্বিধাবোধ করে না। অনেক সময় ব্যক্তিগত কোনো রাগ, ক্ষোভ বা পারিবারিক বিষয়ে কোনো দ্বন্দ্ব থাকলে তারা চলমান সমস্যা সমাধান করে না, বরং আরও তা বৃদ্ধি করে। সমাজ উন্নয়নে তাদের অবদান যে ক্ষীণ, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার দিকে নজর দিলেও দেখতে পাওয়া যায়, তারা গ্রামের সাধারণ মানুষকে রিলিফের চাল, গম, বিভিন্ন নামে বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা ও মাতৃকালীন ভাতার জন্য চার-পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে থাকে। এছাড়া মাঝে মাঝে টিউবওয়েল, গরু ও ভূমিহীনদের জন্য সরকারি বা বেসরকারি এনজিও প্রতিষ্ঠানের সাহায্যগুলো না দিয়ে বিক্রি করে দেয়।
ওপরের বিষয়গুলোর সার্বিক দিক আলোচনা করে বলা যায়, একটি আদর্শবান সমাজ বিনির্মাণে গ্রামীণ আদর্শবান নেতৃত্ব যেমন রোল মডেল, ঠিক তেমনি একটি সমাজে ধ্বংসাত্মক কাজ, অসামাজিকতা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বৃদ্ধি করতেও তারাই মুখ্য ভূমিকা রাখে। একটি পরিবারের বাবা-মা অথবা প্রধান যদি ভালো হয়, তবে পরিবারটা ভালো হবে আশা করা যায়। ঠিক তেমনি একটি ন্যায়নিষ্ঠ, আদর্শবান ও সুশীল সমাজ গঠনে আদর্শবান নেতৃত্ব তদ্রƒপ। তাই আদর্শবান নেতৃত্ব গঠনে এবং আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ, বলিষ্ঠ ও শিক্ষিত মানুষের নেতৃত্বে আশার কোনো বিকল্প নেই। আপনার-আমার সদিচ্ছা ও সার্বিক সহযোগিতায় এগিয়ে যাক সমাজ এবং ফিরে আসুক শান্তি ও সম্প্রীতিÑএটাই কামনা।
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ