বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান, বিশ্বজনীনও। আঞ্চলিকতা, জাতীয়তা, রাষ্ট্র, সীমানা, সব কিছুর ঊর্ধ্বে এ বিদ্যাপীঠের স্থান। যে কোনো অঞ্চলের, যে কোনো দেশের, ভাষা, বর্ণ, জাতীয়তার শিক্ষার্থীই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে। বিচিত্র বিষয়ে বিস্তর জ্ঞান অর্জনের অবারিত ও সীমাহীন সুযোগ কেবল বিশ্ববিদ্যালয়েই পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিজ্ঞ, উদার, সংস্কৃতিমনা। অজ্ঞতা, কুসংস্কার, সংকীর্ণ মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠে এ শিক্ষকরা জাতিগঠনে ব্রতী হন। তাদের চিন্তায় স্বভাবতই দেশ ও জাতির স্বার্থ প্রাধান্য পায়। কোনো বেড়াজাল তাদের জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান পরিবেশনে বাধা তৈরি করতে পারে না। তিনি শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়ানোর পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সভা, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালা, সেমিনারে অংশ নেবেন। গবেষণা করবেন, শিক্ষার্থীদের গবেষণায় উৎসাহিত করবেন। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে নিজের জ্ঞানকে সময়োপযোগী করবেন, বিলিয়ে দেবেন শিক্ষার্থীদের মাঝে। উদ্যমী ও প্রত্যয়ী প্রজন্ম গড়ে তুলবেন শিক্ষকরা। নতুন জ্ঞান, উদ্ভাবনী ভাবনা, বিশ্বজনীনতা, আইনের অনুশাসন, দক্ষ জনশক্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্বে এগিয়ে থাকবেন শিক্ষকরা। শিক্ষকদের গবেষণাকে ভিত্তি করেই রাষ্ট্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। শিক্ষক কোনো কিছুর বিনিময়েই আত্মমর্যাদা ক্ষুন্ন করবেন না।
গবেষণা, সৃষ্টিশীল ভাবনা, শিক্ষাদান, জ্ঞানের নতুন দ্বার উম্মোচনে শিক্ষকরা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবেন। কর্তৃপক্ষ নয়, কেবল নিজের বিবেকের কাছে শিক্ষকরা দায়বদ্ধ থাকবেন। এমন ভাবনা থেকেই বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুমোদন করেন। উচ্চশিক্ষার যে ধারণা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর যে আস্থা রেখে মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা অনেকাংশেই সফল হয়নি। স্বাধীনতা আর উদার পেশাদারত্বের সুযোগ নিয়ে শিক্ষকরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে কতটুকু দায়িত্ব পালন করছেন এ বিষয়টি প্রাসঙ্গিক।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি অংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার বিধান থাকলেও অনেকেই এ নিয়ম মানেন না। এমন শিক্ষকও আছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার অনুমতি নিয়েছেন, কিন্তু ক্লাস নেন একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কোনো কোনো শিক্ষক জড়িত এসব বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায়ও। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল দায়িত্বের বাইরে এসব প্রতিষ্ঠানেই তারা বেশি সময় দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন অবস্থায় আর্থিক সুবিধার কাছে নিজের প্রধান দায়িত্ব, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসটি গৌণ হয়ে পড়ে। এমন শিক্ষকও আছেন, যারা ইচ্ছে করেই বছরের একটি উল্লেখযোগ্য সময় বিভাগে ক্লাস নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। যথাযথ সময়ে পরীক্ষার খাতাও মূল্যায়ন করেন না। শিক্ষকদের এমন কর্মকাণ্ডে বিভাগে সেশনজট তৈরিসহ একাডেমিক জটিলতা তৈরি হয়। এসব শিক্ষকই আবার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সময়ানুবর্তী ও যথেষ্ট দায়িত্বশীল। বিষয়টি হতাশাজনক ও দুর্ভাগ্যের। শিক্ষার্থীরা এসব শিক্ষকের কাছ থেকেই এমন পরিস্থিতিতে নেতিবাচকতা শেখে। সেশনজটের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক সেশন পিছিয়ে পড়ছে। এতে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অপচয় হচ্ছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের। মানবসম্পদ উন্নয়নে জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হচ্ছে। বিষয়টি উল্লেখ করেছে ইউজিসি তাদের নিয়মিত বার্ষিক প্রতিবেদনেও। উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সমাজে শিক্ষকদের সম্পর্কে জন্ম নিচ্ছে নেতিবাচক ধারণা। নিয়ম থাকলেও এসব শিক্ষক নির্ধারিত ক্লাস নেওয়ার নিয়মটি উপেক্ষা করেন। কর্মস্থলে কত সময় থাকবেন, তার কোনো নিয়ম না থাকায় এর সুযোগ নিতে চান এসব শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়ন, সেশনজট হ্রাস, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। হোক সেটা ইউজিসি বা উচ্চশিক্ষা কমিশনের কাছে। ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানও গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক মানসম্মত শিক্ষক রয়েছেন। তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে পারেন। এক্ষেত্রে রিসোর্স থাকলে তা ব্যবহারে বাধা নেই। তবে প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নীতিমালা রয়েছে একজন শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়টি ক্লাস নিতে পারবেন। একজন শিক্ষকের প্রথম দায়িত্ব হলো নিজ বিভাগে ক্লাস নেওয়া। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকরা নিজ বিভাগে সময় না দিয়ে বাইরে ক্লাস নেন বেশি। এমন হওয়া উচিত নয়।’ অধ্যাপক মান্নানের এ বক্তব্যের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। এর সঙ্গে আমি এটুকুও আশা করি, অধ্যাপক মান্নানের নেতৃত্বে পরিচালিত মঞ্জুরি কমিশন একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন করবে। তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নও করা হবে।
শিক্ষকদের আর্থিক কার্যাবলির সঙ্গে জড়িত হওয়ার প্রবণতা রোধ করতে পারে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত বেতনসহ সুবিধা নিশ্চিত করা। যদিও প্রতিবছর শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করা হচ্ছে। তবে এ বিনিয়োগের যথাযথ ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনিয়ম, দুর্নীতি, আর্থিক অব্যবস্থাপনা একটি নিয়মিত চিত্র। এসব রোধ হলে সার্বিক পরিবেশ আরও উন্নত হবে। অস্বীকারের উপায় নেই, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগের বিকল্প নেই। অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। দরকার শিক্ষাসংক্রান্ত উপকরণসহ সব প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করা। দেশে উচ্চশিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের মাত্র দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ বরাদ্দে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ন্যূনতম চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না।
দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর মাধ্যমে শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয়। শ্রীলঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রভাষক থেকে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক পর্যন্ত পাঁচটি ধাপ আছে। সেখানে বর্তমানে একজন প্রভাষকের মূল বেতন প্রতি মাসে সর্বনি¤œ ৩৯,৭৫৪ থেকে সর্বোচ্চ ৪৮,৪৪৫ রুপি। একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক মূল বেতন পান প্রতি মাসে সর্বনি¤œ ৬৭,১০০ থেকে সর্বোচ্চ ৮৭,৭৭৫ রুপি। এই মূল বেতনের বাইরে একজন শিক্ষক জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ ভাতা, একাডেমিক ভাতা হিসেবে মূল বেতনের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পেয়ে থাকেন। এছাড়া রয়েছে গবেষণা ভাতা ও বিশেষ ভাতা। উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক আট বছর চাকরি করার পর শুল্কমুক্ত গাড়ি কিনতে পারেন এবং এ সুবিধা প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নবায়নযোগ্য। এছাড়া মেধাপাচার রোধে অনেক দেশেই রয়েছে উচ্চশিক্ষা ফান্ড। এর আওতায় দেশের সম্পূর্ণ অর্থায়নে উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাবীদের বিদেশ পাঠানো হয়। উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরিয়ে আনার নিশ্চয়তাও ঠিক করা হয়। কেবল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো দরকার উচ্চমাধ্যমিক, মাধ্যমিক, প্রাথমিকসহ সব স্তরে। একটি স্তরের সঙ্গে আরেকটি স্তরের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। একটি স্তরেও নেতিবাচক ফল হলে প্রভাব পড়ে পরবর্তী সময়ে।
উন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা প্রজেক্ট বা কনসালট্যান্সিতে কাজ করেন। এক্ষেত্রে শিক্ষকের বাস্তবভিত্তিক প্রায়োগিক প্রযুক্তি ও সর্বশেষ তথ্যপ্রযুক্তি বা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানলাভ হয়। ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কনসালট্যান্সি বা বিভিন্ন প্রজেক্ট শিক্ষকদের গ্রহণে উৎসাহিত করা হয়। এক্ষেত্রে কনসালট্যান্সি বা প্রজেক্টে তিনি কত সময় ব্যয় করবেন, তার ওপর তার মূল বেতন থেকে কেটে নেওয়া হয়। বিষয়টি এমন, মাস বা বছরের ২০ শতাংশ সময় যদি কোনো শিক্ষক প্রজেক্ট বা কনসালট্যান্সিতে ব্যয় করেন, তবে এ সময়ের বেতন তার মূল বেতন থেকে কেটে নেওয়া হবে। কেটে নেওয়া অর্থ দিয়ে ঠিক ওই ২০ শতাংশ সময়ের জন্য আরেকজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। ইংল্যান্ডে সাধারণত প্রজেক্টগুলো হয় লক্ষাধিক মিলিয়ন পাউন্ডের। প্রপোজাল সাবমিটের পর তা নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়। বিভিন্ন শর্ত ও প্রপোজালের মান নিয়ে এ প্রতিযোগিতা হয়। এর মাধ্যমে কোনো বিভাগ প্রজেক্ট পেয়ে থাকে।
উচ্চশিক্ষাকে বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে হলে মঞ্জুরি কমিশনকে এগিয়ে আসতে হবে। নিতে হবে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। বাঁচাতে হবে দেশের উচ্চশিক্ষাকে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষক, কর্মকর্তা নিয়োগ ও পদোন্নতির একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু তা হতে হবে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি না করে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে এ ব্যাপারটিও দেখতে হবে। মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম একবার ঘোষণা দিয়েছিলেন, অটোমেশনের এমন পদক্ষেপ নেওয়া হবে, যাতে মঞ্জুরি কমিশনে বসেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কয়টি ক্লাস নিচ্ছেন বা প্রশাসনিক কাজে কত সময় ব্যয় করছেন, তা মনিটর করা যাবে। এ পদ্ধতিতে শিক্ষক একটি কার্ড পাঞ্চ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করবেন। তা মঞ্জুরি কমিশনের অটোমেশন সার্ভারের মাধ্যমে মনিটর করা হবে। পরে সে উদ্যোগ আর বাস্তবায়ন হয়নি।
সদস্য, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন সাবেক ভিসি,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
skabir-juÑyahoo.com
Add Comment