ফারিয়া ইয়াসমিন: করোনাভাইরাসের আক্রোশ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না কেউ। করোনাভাইরাসের প্রকোপ শিশুদের মধ্যে কম দেখা গেলেও তারা এই ভাইরাসের নীরব শিকার। শিশুরা মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠে, আবদ্ধ পরিবেশে শিক্ষা তাদের জন্য খাঁচায় বদ্ধ পাখির মতো। করোনা পরিস্থিতি শিশুদের জন্য সে আবদ্ধ পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে; যার ফলে শিশুদের পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সব ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সেটা বাড়িতে বসে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হলেও প্রাথমিক শিশুদের জন্য খুব বেশি কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে বীজ। প্রাথমিক স্তরকে অন্যান্য শিক্ষার ভিত্তিস্তর হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু করোনার কারণে এই প্রাথমিক স্তরকে শক্ত ভিত হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। শিশুদের শিক্ষণ শিখন কার্যক্রম ও শিখন ফলের মধ্যে ব্যাপক তারতম্য তৈরি হচ্ছে এ পরিস্থিতিতে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই স্তর থেকেই শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া সৃষ্টি হয়। শিশুর সহজ-সাবলীল মনের অন্তরালের সৃজনশীলতা বিকশিত করতে না পারলে শিশুমনের সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়।
শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শিশুদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনার নীরব শিকার হয়ে শিশুদের শ্রেণিকক্ষে প্রত্যক্ষভাবে পাঠদান করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে তাদের মানসিক উন্নতিতে ব্যাঘাত ঘটেছে। করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেশের তিন কোটি ৭০ লাখ শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ এবং শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের প্রথম দিকে কভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর থেকে স্কুল বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে তিন কোটি ৭০ লাখ শিশুর এবং দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব এশিয়াসহ এশিয়ার প্রায় ৮০ কোটি শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে।
ইউনিসেফ ও ইউনেসকো বলছে, ক্রমাগত স্কুল বন্ধ থাকার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোর পরিণতি অত্যন্ত গুরুতর; যার মধ্যে রয়েছে পড়াশোনার ক্ষতি, মানসিক দুর্দশা, স্কুলের খাবার ও নিয়মিত টিকা না পাওয়া, কাঠামোগত শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি এবং শিশুশ্রম ও বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি। এই ভয়াবহ পরিণতিগুলোর মধ্যে অনেকগুলো এরই মধ্যে অসংখ্য শিশুকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং অনেকগুলো আগামী বছরগুলোয় অনুভূত।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পর ২০২২ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ এ দেশের অর্থনীতি থেকে শুরু করে সব খাতেই প্রভাব পড়ছে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এর প্রভাব বেশি লক্ষণীয়; কেননা দেশের জনসংখ্যার শিক্ষার্থীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। আর তাদের ভবিষ্যৎ বিনষ্টের দিকে এগিয়ে গেলে সেটা সবার কাছেই লক্ষণীয় বিষয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নিন্ম ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় স্কুলবন্ধের কারণে পড়াশোনার ক্ষতি হওয়ায় ১০ বছর বয়সীদের ৭০ শতাংশ সহজ পাঠ পড়া বা বোঝার সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি, যা মহামারির আগের সময়ের তুলনায় ৫৩ শতাংশ বেশি।
ইথিওপিয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা স্বাভাবিক শিক্ষাবর্ষে যে পরিমাণ গণিত শিখতে পারত, তার মাত্র ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ শিখতে পেরেছে বলে ধারণা করা হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকায় স্কুলগামী শিশুদের শিক্ষাবর্ষে যে অবস্থানে থাকার কথা, তার চেয়ে তারা ৭৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত পিছিয়ে আছে।
২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের জুলাইয়ের মধ্যবর্তী সময়ে প্রায় চার থেকে পাঁচ লাখ শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে বলে জানা গেছে। শিশু শিক্ষা ব্যাহত হওয়ার দৃষ্টান্ত শুধু আমাদের দেশেই লক্ষণীয় নয়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত পৃথিবীর অন্যান্য দেশে একই পরিস্থিতি লক্ষণীয়।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, কভিড-১৯ মোকাবিলার ক্ষেত্রে স্কুল বন্ধ করতে হলে তা অবশ্যই শেষ অবলম্বন হিসেবে অস্থায়ী ভিত্তিতে করতে হবে। সংক্রমণের ঢেউ সামাল দিতে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, তার মধ্যে প্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষেত্রে সবার শেষে এবং খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবার আগে স্কুল থাকা উচিত।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পর তা খুলে দেয়াতেই কার্যক্রম শেষ হয়ে যায় না। শিক্ষায় বিশাল আকারের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনা দরকার। এটা সত্য যে, করোনার কারণে শিক্ষার ছত্রছায়া থেকে অনেক শিক্ষার্থী দূরে সরে গেছে। তাদের আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে আনতে সরকারকে দীর্ঘ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। করোনার কারণে শিক্ষায় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হলে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। শিক্ষাই পারে একটি দেশ ও জাতিকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে নিয়ে যেতে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমন দুর্বল অবস্থায় ফেলে রাখলে চলবে না। যেখানে প্রশ্ন দেশের লাখ লাখ শিশু শিক্ষার ব্যাপারে সেখানে আরও বেশি দৃঢ়চেতা হতে হবে।
শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে শুধু শিক্ষার পরিবেশ জড়িত নয়, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে শিশুর শারীরিক-মানসিক বিকাশ, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সামাজিক উন্নতি এবং শিশুর পুষ্টিবিষয়ক সচেতনতা। করোনার কারণে সব বিষয়ে ব্যাঘাত ঘটেছে; যার ফলে শিশু শিক্ষা হচ্ছে। শিশু শিক্ষার সঙ্গে একটি পরিবারের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা জড়িয়ে থাকে। যে পরিবার অর্থনৈতিকভাবে যত বেশি সচ্ছল তারা শিশুর জন্য তত বেশি সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। করোনার কারণে অধিকাংশ পরিবারের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা কমে গেছে। দারিদ্র্যের খাতায় নাম লিখছে অনেক নি¤œবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবার। যার ফলে এসব পরিবার থেকে শিশুদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ ও বাড়িতে বসে পাঠদানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে না। করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠলেও এই সমস্যার সমাধান করতে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে।
মহামারিকালে স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুরা গণনা ও স্বাক্ষরতার মৌলিক দক্ষতা হারিয়েছে। শিশুকে শ্রেণিকক্ষে প্রত্যক্ষভাবে যেভাবে শিক্ষাদান করা হয় বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটা সম্ভব না হওয়ায় এমন নজির দৃষ্টান্ত।
বৈশ্বিকভাবে পড়াশোনায় ব্যাঘাতের অর্থ হলোÑলাখ লাখ শিশু শ্রেণিকক্ষে থাকলে যে একাডেমিক শিক্ষা অর্জন করতে পারত, তা থেকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বঞ্চিত হয়েছে, যেখানে ছোট ও আরও বেশি প্রান্তিক শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। শিশু শিক্ষায় একাডেমিক শিক্ষার গুরুত্ব রয়েছে। সেসব শিশুদের জন্য একাডেমিক শিক্ষা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ যারা চর অঞ্চল, পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করে এবং উপজাতি। এসব শিশুদের বেড়ে ওঠা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের তুলনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ অনেক বেশি অনুকূল হয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে এসব শিশুদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে।
স্কুল বন্ধ থাকার কারণে এর নেতিবাচক প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। স্কুল বন্ধ থাকায় তা পড়াশোনার ক্ষতির পাশাপাশি শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করেছে, তাদের নিয়মিত পুষ্টিপ্রাপ্তির উৎস কমিয়ে দিয়েছে। প্রান্তিক শিশুদের ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ হয়েছে।
ক্রমে উঠে আসা তথ্য-প্রমাণ দিচ্ছে যে, কভিড-১৯ শিশু ও তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চহারে উদ্বেগ ও বিষন্নতা সৃষ্টি করেছে, যেখানে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, মেয়ে, কিশোর-কিশোরী ও গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারীরা অধিকহারে এ সমস্যাগুলোর সম্মুখীন। গ্রামীণ পরিবেশ আর শহরে পরিবেশের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। শহরে বেড়ে ওঠা শিশু করোনা পরিস্থিতিতে যেভাবে বেড়ে উঠছে গ্রামীণ পরিবেশ থেকে শিশুরা সেভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণের ধরনটা ভিন্ন।
স্কুল বন্ধ থাকার সময় বিশ্বব্যাপী ৩৭ কোটিরও বেশি শিশু স্কুলের খাবার থেকে বঞ্চিত হয়, যা কিছু শিশুর জন্য খাবার ও দৈনিক পুষ্টিপ্রাপ্তির একমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎস এবং তারা সেটা হারায়।
প্রাথমিক শিক্ষায় শিশুদের অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি করার জন্য স্কুলে খাবার প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিদ্যালয়ের দীর্ঘসময় অবস্থানরত এসব শিশুদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ ও বিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য খাদ্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিশুরা এই পুষ্টি চাহিদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব বিশেষ করে তাদের ওপর প্রভাব পড়ছে যারা প্রান্তিক শিশু।
পড়াশোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শিক্ষার্থীদের নিবিড় সহায়তা প্রয়োজন। শিশুদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য, সামাজিক বিকাশ এবং পুষ্টি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে স্কুলগুলোকে শুধু শেখানোর নির্ধারিত গণ্ডির বাইরেও যেতে হবে। সযতেœ নিবিড় পরিচর্যার ফলস্বরূপ শিশুরা আবার শিক্ষায় নিজেকে আগ্রহী করতে পারবে। এক্ষেত্রে সরকার, পরিবার, শিক্ষক সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
শিক্ষার্থী
শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়