মিরপুর মুক্ত দিবস

কাজী সালমা সুলতানা: আজ মিরপুর মুক্ত দিবস। সুদীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের পর একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায়  নতুন  রাষ্ট্র বাংলাদেশ; কিন্তু ঢাকার মিরপুর তখনও অবরুদ্ধ।

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও বিহারিদের নিয়ে গঠিত সিভিল আর্মড ফোর্স আত্মসমর্পণ করেনি। তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিরপুরে আশ্রয় নেয়। মিরপুরে তখন প্রায় এক ব্রিগেড পাকিস্তানি সেনাকে সঙ্গে নিয়ে গড়া হয় স্বাধীন বাংলাদেশের ভেতর এক পরাধীন বাংলা। অবাধে বাঙালি নির্যাতন আর হত্যার জন্য পুরো মিরপুর ছিল পাকিস্তানিদের কাছে জল্লাদখানা। মুক্তিযোদ্ধারা একাধিকবার মিরপুরে প্রবেশ করতে চাইলেও মিত্রবাহিনী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শত্রুশক্তি অনুমান করে তাদের বিরত রাখে।

মেজর জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ ইব্রাহিম তার ‘সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে আটাশ বছর’ বইতে লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে উর্দুভাষী বিহারি মুসলমানরা বিনা দ্বিধাতেই পাকিস্তানকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রায় ২০ হাজার বিহারিকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে সিভিল আর্মড ফোর্স গঠন করা হয়। তাদের অনেক যুবক রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাক কর্তৃপক্ষ তাদের মধ্যে প্রচুর অস্ত্র বিতরণ করে।’  যুদ্ধ যতই সমাপ্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, বিহারিদের মাঝে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ততই তৈরি হচ্ছিল। মুহাম্মদ ইব্রাহিম তার বইতে উল্লেখ করেন, ‘তাদের ওপর মুক্তি বাহিনীর পক্ষ থেকে যদি কোনো আক্রমণ আসে, তা থেকে বাঁচার জন্য তারা নিজেদের সশস্ত্র ও সংগঠিত করে তোলে।’ 

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন। ৩০ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে সব মুক্তিযোদ্ধার কাছে থাকা অস্ত্র জমা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পাকিস্তানিদের অস্ত্র সমর্পণ করার ঘোষণা দিলেও মিরপুরে মাইকে ঘোষণারত পুলিশ সদস্যকে তারা হত্যা করে। অবরুদ্ধ মিরপুরকে মুক্ত করতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, পুলিশসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকবার অপারেশন পরিচালনা করেও ব্যর্থ হন।

১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি বিজয়ের দেড় মাস পর পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয় মিরপুর। প্রায় দেড় মাস মিরপুরে বসবাসরত বিহারি, সাদা পোশাকে পরাজিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কিছু সৈন্য এবং সঙ্গে তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা বাঙালিদের হত্যা করাসহ নির্যাতন চালিয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধকালে মোহাম্মদপুর ও মিরপুর থানার গেরিলা কমান্ডার (মামা গ্রুপ) ছিলেন শহীদুল হক (মামা)। মিরপুর মুক্ত করার কৌশল নির্ধারণের জন্য ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার শহীদ কর্নেল এটিএম হায়দার বীর উত্তম ও শহীদুল হকের নেতৃত্বে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর বিহারি কর্তৃক লুণ্ঠিত মালামাল বেচাকেনার বাজারটি (মিরপুর ৬ নম্বর সেকশন) গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর ২৯ জানুয়ারি শহীদুল হক মামার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা একযোগে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু আত্মগোপনকারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, তাদের এদেশীয় দোসর বিহারি ও রাজাকারদের হাতে থাকা প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ ও ভারী অস্ত্রের কাছে শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেননি মুক্তিযোদ্ধারা। যুদ্ধের প্রথম অভিযানেই নিহত হন বাঙালি সেনাসহ পুলিশের ১২২ সদস্য। শহীদ হন সেনাবাহিনীর লে. সেলিম ও পুলিশের এএসপি জিয়াউল হক খান লোদী। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে লে. সেলিমই যুদ্ধ পরিচালনা করে মুক্ত করেন অবরুদ্ধ মিরপুর। সে সময় তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির প্রথম গার্ড কমান্ডার। মিরপুরকে শত্রুর দখল মুক্ত করতে বীরের মতো যুদ্ধ করে শহীদ হন তিনি।

এ অভিযান শুরু হয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কথাশিল্পী জহির রায়হান নিখোঁজ অগ্রজ সাহিত্যিক-সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে আসার পর। তিনি মিরপুরে এই অভিযানে অংশগ্রহণ করেন ও নিখোঁজ  হন। মিরপুরের যুদ্ধে ৪১ সামরিক বাহিনীর সদস্য, শতাধিক পুলিশ ও মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। তবে এ শহিদদের কোনো স্বীকৃতি মেলেনি। সরকারি গেজেটেও তাদের নাম নেই। নেই কোনো স্মারকচিহ্ন।

মিরপুর শত্রুমুক্ত হওয়ার পর একে একে বেরিয়ে আসে রাজাকার, আলবদর ও বিহারিদের পৈশাচিক বীভৎসতার সাক্ষী বধ্যভূমিগুলো। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক গবেষক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা এমএ হাসান লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালে সারাদেশে একটি বধ্যভূমি বানিয়েছিল হানাদার পাকিস্তানি ও তাদের দোসররা। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি গণহত্যা-সংক্রান্ত যে গবেষণা চালায়, তাতে জানা যায়, দেশে প্রায় পাঁচ হাজার ছোট-বড় বধ্যভূমি রয়েছে। এর মধ্যে ৯২০টি বধ্যভূমিকে শনাক্ত করা গেছে। ঢাকায় শুধু মিরপুরের বিভিন্ন স্থানে ২৩টি বধ্যভূমি শনাক্ত করা গেছে। এগুলো হলোÑ১. জল্লাদখানা, ২. মুসলিম বাজার, ৩. মিরপুর ১২ নম্বর সেকশন পানির ট্যাংক, ৪. মিরপুর ১০ নম্বর সেকশন ওয়াপদা বিল্ডিং, ৫. মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশন, ৬. মিরপুর ১০/সি লাইন ১৪ নম্বর সেকশন, ৭. মিরপুর ১৪ নম্বর সেকশন, ৮. মিরপুর ১৪ নম্বর কবরস্থান, ৯. সিরামিক ফ্যাক্টরি, ১০. শিয়ালবাড়ী, ১১. হরিরামপুর, ১২. মিরপুর ব্রিজ, ১৩. ১২ নম্বর সেকশনের কালাপানির ঢাল, ১৪. রাইনখোলা বধ্যভূমি, ১৫. মিরপুরের দারুল রশিদ মাদরাসা, ১৬. মিরপুরের বায়তুল আজমত জামে মসজিদ, ১৭. আলোকদি, ১৮. বাঙলা কলেজ, ১৯. বাংলা কলেজের কাছে আমবাগান, ২০. ১ নম্বর সেকশনের সারেংবাড়ী, ২১. চিড়িয়াখানার কাছে সিন্নিরটেক, ২২. গোলারটেক ও ২৩. কল্যাণপুর বাসডিপো।

গণমাধ্যমকর্মী

salma15august@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০