জয়নাল আবেদিন: মালিকবিহীন আট কোটি ৭৯ লাখ টাকা পড়ে আছে ব্যাংকে। দেশি-বিদেশি ব্যাংকের অনেক অ্যাকাউন্টে পড়ে থাকা এসব অদাবিকৃত আমানতের মালিকের কোনো হদিস পাচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অ্যাকাউন্টগুলোয় ১০০ টাকা থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত আমানত জমা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, ওই আমানতের গ্রাহক বা তার উত্তরাধিকারীদের ফিরিয়ে দিতে এক বছর পরপর হিসাবধারীর নাম, হিসাব নম্বর, টাকার পরিমাণসহ বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ওয়েবসাইটে তথ্য প্রকাশ করে থাকে। এ সময় কোনো দাবিদার উপযুক্ত প্রমাণ দিতে পারলে তার অর্থ ফেরত দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সরিয়ে ফেলার পর আরও এক বছর বাংলাদেশ ব্যাংক ওই অর্থ ফেরত দিতে রাজি থাকে। প্রতিবছর এপ্রিলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে অদাবিকৃত আমানত জমা নেয়। অর্থাৎ সব মিলিয়ে অন্তত ১২ বছর তিন মাস সময় দেয়া হয় অদাবিকৃত আমানত গ্রাহককে ফেরত নেয়ার জন্য। এরপরও যেসব আমানতের দাবিদার পাওয়া যায় না, সেসব আমানতের অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দেয়া হয়।
জানা গেছে, ২০১৬ সালে প্রায় ১৬ লাখ টাকা অদাবিকৃত আমানতের দাবিদার ফিরে আসেন এবং তাদের অর্থ বুঝিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা হওয়া ১০ কোটি ৬৮ লাখ টাকার দাবিদার না পাওয়ায় ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা দিয়েছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ১০ বছর ধরে পড়ে থাকা অদাবিকৃত টাকা বছরে একবার ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে বুঝে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আট কোটি ৭৯ লাখ ১৪ হাজার টাকার অদাবিকৃত আমানত জমা পড়েছে, যার দাবিদার খুঁজে চলেছে সংস্থাটি।
‘ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০১৮ পর্যন্ত সংশোধিত)’-এর ৩৫ ধারা অনুযায়ী ১০ বছর ধরে কোনো ব্যাংক হিসাবে লেনদেন না হলে এবং ওই আমানতের গ্রাহককে খুঁজে না পাওয়া গেলে, সে অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা করতে হয় ব্যাংকগুলোকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ১১টি ব্যাংক অদাবিকৃত আমানত পাঠিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক পাঠিয়েছে এক লাখ ৬০ হাজার ৪৯০ টাকা, ব্যাংক এশিয়া ৯৪ লাখ ১৩ হাজার ১২৩ টাকা, এক্সিম ব্যাংক সাত লাখ ৭৭ হাজার ৪৭৫ টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এক লাখ ৫২৭ টাকা, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ২৮ লাখ ৫১ হাজার ২৮৯ টাকা, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ছয় লাখ ৯ হাজার ৭৬৭ টাকা, প্রাইম ব্যাংক সাত লাখ ৩১ হাজার ৭১৬ টাকা, সিটি ব্যাংক পাঁচ কোটি ৭৭ লাখ ৩২ হাজার ৮৪৭ টাকা, বিদেশি হাবিব ব্যাংক ২৬ লাখ ৬১ হাজার ৬০ টাকা, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ৩৩ লাখ ৯১ হাজার ৮৮৯ টাকা ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া পাঁচ লাখ ৩২ হাজার ৪৯ টাকা পাঠিয়েছে।
জানা যায়, ইসলামী ব্যাংকের মিরপুর শাখায় বিল্লালুর রহমান নামের এক গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে ৭৫ টাকা জমা ছিল। ২০০৮ সালের ১৪ অক্টোবরের পর ওই অ্যাকাউন্টে আর কোনো লেনদেন হয়নি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বিল্লালুর রহমানকে বের করতে পারেনি ব্যাংকটি। বিল্লালও আর কখনও আসেননি টাকাগুলো তুলতে। এ রকম শত শত অ্যাকাউন্টের টাকা নির্দিষ্ট সময় পার হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক টাকাগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক সময় গ্রাহক মারা গেলে বা নিখোঁজ হলে বা প্রবাসে চলে গেলে ব্যাংক হিসাবে জমা থাকা টাকা তোলা হয় না। তাছাড়া অনেক সময় পে-অর্ডারের প্রাপকের নাম-ঠিকানার ভুলে বা অনিষ্পন্ন কোনো বিল পরিশোধ না হলে, এমন যেকোনো দায় পরিশোধ না করা গেলে সেই অর্থও অদাবিকৃত থেকে যায়।
ব্যাংকগুলো অবশ্য লেনদেনের নিরাপত্তার স্বার্থে ছয় মাস থেকে দুবছর সময়ের মধ্যে কোনো ব্যাংক হিসাবে লেনদেন না হলে ওই হিসাব ব্লক করে রাখে। এমন হিসাবের বয়স ১০ বছর হয়ে গেলে ব্যাংক থেকে গ্রাহকের স্থায়ী বা বর্তমান ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়ে তিন মাস অপেক্ষা করতে হয় জবাবের জন্য। তবে ব্যাংকগুলো বলছে, গ্রাহক প্রান্ত থেকে অনেক ক্ষেত্রে কোনো জবাব আসে না। কখনও কখনও ঠিকানা বদল করায় গ্রাহকের কাছ পর্যন্ত পৌঁছানো যায় না। অনেক সময় ঠিকানা ভুল থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে, এ ধরনের গ্রাহকের সঙ্গে রেজিস্ট্রি চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করার জন্য। দাবিদার না পাওয়া গেলে ওই অর্থ সুদসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে থাকা ‘আনক্লেইমড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট’-এ জমা করতে হয় ব্যাংকগুলোকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তার মতে, সঞ্চয়ী হিসাবের মতো মেয়াদি আমানতের ক্ষেত্রেও ১০ বছর সময় দেয়া হয়। তবে এ ক্ষেত্রে মেয়াদি আমানতের মেয়াদপূর্তির ১০ বছর পর গ্রাহককে খোঁজা হয়। খোঁজ পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় ওই টাকা জমা দেয়। এমনি করে ব্যাংকের লকারে থাকা মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রীও অদাবিকৃত হলে তা জমা নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে পড়ে থাকা আমানত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানোর নির্দেশনা রয়েছে। ব্যাংকগুলো সেটা পরিপালনও করছে। তবে যারা এখনও তথ্য দেয়নি, পরিদর্শনের মাধ্যমে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। এসব অর্থ একটি নির্ধারিত সময় পর আমরা সরকারি কোষাগারে জমা দিই। এ প্রক্রিয়া এখনও চলমান বলেও জানান তিনি।