নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রায় ১০ হাজার দাবি নিষ্পত্তি। তাও মাত্র এক পক্ষকালে (১৫ দিনে)। টিমওয়ার্ক থাকলে সবই সম্ভব। শুল্ক রেয়াত ও প্রত্যপর্ণ পরিদপ্তর (ডেডো) এমন অবিশ্বাস্য কাজটি করেছে। দাবির মধ্যে বেশিরভাগই বিদেশি সংস্থা ও দূতাবাস, যা বছরের পর বছর নিষ্পত্তি হয়নি। আর ১০ হাজার দাবির আবেদন নিষ্পত্তিতে ভ্যাট ফেরত দেয়া হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। বিদেশি সংস্থা আর দূতাবাসের দাবি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তিতে নেয়া হয়েছে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম। আর এই ক্র্যাশ প্রোগ্রামের আওতায় এখন প্রতিদিন প্রায় দুই হাজারের বেশি দাবি নিষ্পত্তি হচ্ছে। মূলত নতুন মহাপরিচালক যোগদানের মাত্র ১৫ দিনের মধ্যেই এমন অসাধ্য কাজ সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন ডেডোর কর্মকর্তারা।
## মাত্র ১৫ দিনে ভ্যাটের প্রায় ১০ হাজার দাবি নিষ্পত্তি, যা গত এক বছরেও হয়নি
## তালিকায় ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ, ইউএনডিপি, আইএলও, আইসিডিডিআরবি
## জাপান, জার্মানি, নরওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, কুয়েত, সুইজারল্যান্ড, সৌদি আরব দূতাবাস
ডেডোর সূত্রমতে, রপ্তানি খাতকে উৎসাহ দিতে ১৯৮৭ সালে রাষ্ট্রপতির এক আদেশে ডেডো প্রতিষ্ঠিত হয়। ডেডোর কাজের ধরণ এনবিআরের অন্য সংস্থার মতো নয়। শুল্ক প্রত্যর্পন, রপ্তানি সহগ নির্ধারণ, রিফান্ড, প্রকৃত ও সমহার নির্ধারণ, আবেদন ও মামলা নিষ্পত্তি, ভুল সংশোধন ও সমন্বয়, প্রার্থীর চেক ইস্যু, প্রশাসনিক কাজ ইত্যাদি। ডেডো ৪৮টি বিদেশি সংস্থা ও দূতাবাস নিয়ে কাজ করে।
ডেডো সূত্রমতে, ১৬ জানুয়ারি মহাপরিচালক হিসেবে কমিশনার বেলাল হোসাইন চৌধুরী যোগদান করেন। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দূতাবাস, বিদেশি সুবিধাভোগী ও আন্তর্জাতিক বিশেষায়িত সংস্থার অনিষ্পন্ন আবেদন নিষ্পত্তিতে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেয়া হয়। ডেডোর সকল কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে সম্পন্ন করতে এই ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেয়া হয়। ডেডোর সহকারী পরিচালক মিয়া মো. নাজমুল হক, শরীফ মো. আল আমিন ও মো. মোফাজ্জল হোসেন এর নেতৃত্বে তিনটি কমিটি গঠন করা হয়। ক্র্যাশ প্রোগ্রামের আওতায় ১৭ জানুয়ারি থেকে দাবি নিষ্পত্তি শুরু হয়। দাবি নিষ্পত্তিতে ডেডো থেকে সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কমিশনারেট, ভ্যাট সার্কেলে চালান ও ভ্যাট সংক্রান্ত তথ্য যাচাইয়ের জন্য চিঠি দেয়া হয়। তবে চিঠি দেয়া হলে সার্কেল থেকে যাচাই হয়ে আসতে সময়ক্ষেপণ হয়। সেজন্য চিঠি দেয়ার পাশাপাশি ডেডোর কর্মকর্তারা ফোনে সংশ্লিষ্ট সার্কেল থেকে তথ্য যাচাই করে নিয়ে আসতেছে। যার ফলে কাজের গতি কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এছাড়া কমিশনার সরাসরি তদারকি করায় দাবি নিষ্পত্তির পরিমাণ বেড়ে গেছে।
সূত্রমতে, ১৭ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৫ দিনে প্রায় ১০ হাজার দাবি নিষ্পত্তি হয়েছে। যাতে ফেরতযোগ্য ভ্যাটের পরিমাণ প্রায় ২০ কোটি টাকা। নিষ্পত্তি করা দাবির মধ্যে বিদেশি সুবিধাভোগী ও আন্তর্জাতিক বিশেষায়িত সংস্থার সংখ্যা বেশি। যার মধ্যে রয়েছে-ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ, ইউএনডিপি, ইউএনএফপিএ, ডব্লিউএফপি, আইএলও, আইবিআরডি, আইএফসি, আইসিডিডিআর’বি। দূতাবাসের মধ্যে রয়েছে-জাপান, জার্মানি, নরওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, কুয়েত, সুইজারল্যান্ড, সৌদি আরব ইত্যাদি।
ডেডোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মাত্র ১৫ দিনে দাবি নিষ্পত্তি ও ভ্যাট ফেরাত দেয়ার রের্কড সৃষ্টি হয়েছে। এখন দিনে অন্তত দুই হাজার দাবি নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। প্রতিদিন এই সংখ্যা বাড়তেছে। তবে ডেডোতে জনবলের তীব্র সংকট রয়েছে। এখানে অনুমোদিত জনবলের অর্ধেক পদায়িত রয়েছে। এছাড়া নথি সংরক্ষণের জায়গা নেই। ডেডোতে প্রায় ২৫ হাজার দাবি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১৫ দিনে ১০ হাজার নিষ্পত্তি হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে মাত্র দুই মাসে সব দাবি নিষ্পত্তি হবে বলে মনে করেন ডেডোর কর্মকর্তারা।
ডেডোর হিসাবমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে কোন দাবি নিষ্পত্তি ও ভ্যাট ফেরত দেয়া হয়নি। অক্টোবর থেকে জুন পর্যন্ত নয় মাসে প্রায় ৪৯ কোটি টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। আর দাবির আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৪২টি, অনিষ্পন্ন আবেদন ছিলো ৪ হাজার ৯৮২টি। আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই মাসে কোন দাবির আবেদন নিষ্পত্তি হয়নি। আগস্ট মাসে প্রায় ১৬ কোটি, সেপ্টেম্বর মাসে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি, অক্টোবর মাসে প্রায় ১৬ কোটি, নভেম্বর মাসে প্রায় ৯ কোটি ও ডিসেম্বর মাসে প্রায় ৮ কোটি টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয়মাসে প্রায় ৫৭ কোটি টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে। এই ছয়মাসে আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে ২৯৩টি, অনিষ্পন্ন ছিলো ৫ হাজার ২১৯টি। অথচ ১৭ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দাবির আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে প্রায় ১০ হাজার, যাতে ভ্যাট ফেরত দেয়া হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা।
ডেডোর একাধিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে ডেডোর রিফান্ড আবেদন এর ফরমেট পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন লোগো করা হয়েছে। অফিসের জায়গা বাড়ানো, সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ শুরু হয়েছে। আবেদন নিষ্পত্তি, রিফান্ডসহ সব ধরনের কাজ মনিটরিং এর আওতায় আনা হয়েছে। সর্বোচ্চ দাবি নিষ্পত্তিকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পুরস্কৃত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যাতে কাজের গতি বাড়ে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য তৈরি হয়।
কর্মকর্তারা আরো জানিয়েছেন, বিদেশি সংস্থা ও দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুনাম বর্হিবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে এসব সংস্থা ও দূতাবাসকে সর্বোচ্চ সেবা প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে ডেডো। সেজন্য তাদের সেবার পাশাপাশি ব্যতিক্রমধর্মী পুরস্কার দেয়া হবে। এছাড়া অন্য সেবা প্রার্থীদেরও পুরস্কার দেয়া হবে।
মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চলছে অফিস সাজানোর কাজ। বসানো হয়েছে কার্পেট। দাবি আবেদন নিষ্পত্তিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এ বিষয়ে মহাপরিচালক মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, ১৬ জানুয়ারি আমি যোগদান করেই জানলাম প্রায় ৫ হাজার পুরনো নথি এবং কুটনৈতিক ও বিদেশি সংস্থার ২০ হাজার পৃথক দাবি নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। প্রথম দিন সভা করে পরদিন ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু করি। উদ্দেশ্য, দূতাবাস, বিদেশি সুবিধাভোগী ও আন্তর্জাতিক বিশেষায়িত সংস্থা এবং অংশীজনদের দাবি অগ্রাধিকার নিষ্পত্তি। ২০১৮ সাল ও পরের এক হাজার নথিতে এ রকম প্রায় ২০ হাজার দাবি। এর মধ্যে ইউএনএইচসিআর দাবিই ৪০ কোটি টাকা। ইউনিসেফ এর আরো বেশি হবে। জনবল, জায়গার সংকট রয়েছে। তবে আমার পুরো টিম চমৎকার কাজ করছে। আশা করি আগামী দুই মাসের মধ্যে সব পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমাদের উদ্দেশ্যই থাকবে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান।
