নিজস্ব প্রতিবেদক: অল্প সময়ের ব্যবধানে তামহা সিকিউরিটিজে থাকা বিনিয়োগকারীদের সব বিও (বেনিফিশিয়ারি) হিসাবের সবার মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করা হয়েছে। দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে সব বিনিয়োগকারীদের শেয়ার প্রায় শূন্য হয়ে গেছে। একটি সিকিউরিটিজ প্রতিষ্ঠানের সব বিনিয়োগকারীর শেয়ার শূন্য হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি অস্বাভাবিক হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থা। নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতায় এখন পথে বসেছেন বিনিয়োগকারীরা। এমন দাবি করেছেন তামহা সিকিউরিটিজের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা। গতকাল রাজধানীতে ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্ট ফোরামের (সিএমজেএফ) মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বিনিয়োগকারী ফখরুল ইসলাম বলেন, তামহা সিকিউরিটিজ প্রতিদিনই বিনিয়োগকারীদের পোর্টফলিও পাঠিয়েছে। সেখানে নিয়মিত দেখা যেতÑশেয়ার লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয় তথ্য ও মূলধনের পরিমাণ। কিন্তু অনিয়মের বিষয়টি সামনে এলেই আমরা জানতে পারি এগুলো তামহার পক্ষ থেকে বানানো ভুয়া রিপোর্ট। এমনকি সিডিবিএলে থাকা আমাদের বিও হিসাবের মোবাইল নম্বরগুলোও বদলে ফেলা হয়েছে। বিষয়টি আমরা জানিই না। এখন সিডিবিএলে গিয়ে দেখি আমাদের শেয়ার নেই। এত বড় একটি দুর্নীতি ও জালিয়াতি হলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও পুঁজিবজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) জানলই না। এটি আমাদের হতবাক করেছে।
অথচ সিকিউরিটজ প্রতিষ্ঠানের তৎপরতা দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিদর্শন করার ৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় এরই মধ্যে হাউসটির লেনদেন বন্ধ করে দেয়া হলেও টাকা আদায়ের কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে এসব কার্যক্রমের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) গাফিলতিকে দায়ী করছেন ভুক্তভোগীরা।
বিনিয়োগকারীরা বলেন, সম্প্রতি তামহা সিকিউরিটিজের মালিক ডা. হারুন জালিয়াতির মাধ্যমে ডুপ্লিকেট সফটওয়্যার ব্যবহার করে সব শেয়ার বিক্রি করে দেন। তবে তিনি বাঁচার জন্য অফিস স্টাফদের ওপর দোষ দিচ্ছেন। তার হাউসে দুর্নীতি হয়েছে বলে নিজেও তিনি বিএসইসিতে অভিযোগ জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি নিজেই মূল দুর্নীতিবাজ বলে অভিযোগ বিনিয়োগকারীদের।
পরে ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর হাউসটির ট্রেক (লেনদেনের অধিকার) স্থগিত করে দেয় বিএসইসি। ইলেট্রনিক পদ্ধতির শেয়ার সংরক্ষণকারী কোম্পানি সিডিবিএলে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, আমাদের বিও হিসাবে কোনো শেয়ার নেই। জালিয়াতির বিষয়টি গোপন রাখতে দুই শতাধিক বিনিয়োগকারীদের মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করে তামহা সিকিউরিটিজ। এরপর ডুপ্লিকেট সফটওয়্যার ব্যবহার করে আমাদের ক্রয়-বিক্রয়ের এসএমএস ও মেইলে প্রতিদিনের হালনাগাদ তথ্য দিত। এ কারণে তাদের জালিয়াতির বিষয়টি বোঝা কঠিন হতো। সিকিউরিটিজ হাউসটির মালিকসহ তার দুই ভাইবোন প্রায় শতকোটি টাকা লুটপাট করে নিয়ে যান।
বিনিয়োগকারীরা বলেন, তাদের আবেদন ছাড়া সিডিবিএল কীভাবে মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করল, তা রহস্যজনক। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মনিটরিংয়ের অভাবে তারা সবকিছু হারিয়েছেন বলে অভিযোগ তাদের। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঠিকমতো মনিটরিং করলে এ ধরনের জালিয়াতি ঘটত না বলেও উল্লেখ করেন ভুক্তভোগীরা।
বিনিয়োগকারীরা বলেন, আমরা বিএসইসির চেয়ারম্যানকে বলেছি, অর্থ আত্মসাৎকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে শেয়ার ফেরতের উদ্যোগ নিন। দুই শতাধিক বিনিয়োগকারী তিন মাস ধরে পথে পথে ঘুরেছি। কখনও বিএসইসি আবার কখনও ডিএসইতে। কেউ টাকা ফেরতের আশ্বাস দিচ্ছেন না। করোনার মধ্যে সবকিছু হারিয়ে আমরা অসহায়।
ভুক্তভোগী ফখরুল ইসলাম বলেন, কোম্পানি থেকে শুরুতে ১৫ দিনের মধ্যে সমাধানের আশ্বাস দিয়েছিল, কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। ভুক্তভোগী মজিবুর রহমান বলেন, ১৩ লাখ টাকা এই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছি। এগুলো চাকরির পেনশনের টাকা। এখন কোনো টাকা নেই। এখন আমার সংসার চালাতে সমস্যায় পড়েছি। আমার স্ত্রী খুবই অসুস্থ। তার চিকিৎসাও হচ্ছে না।
অপর বিনিয়োগকারী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান বলেন, আমার পেনশনের ১৩ লাখ টাকার পুরোটাই বিনিয়োগ করেছি। আমার পেনশন ও এ বিনিয়োগ থেকে সংসার চালাতাম। এখন টাকা হারিয়ে দিশাহারা হয়েছি।
অপর বিনিয়োগকারী রওশন আরা বলেন, গহনা ও ব্যাংকের এফডিআর ভেঙে এখানে ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। এখন কই যাব? টাকা কবে পাব, তা জানতে পারছি না। সবাই শুধু অপেক্ষা করতে বলছে।
উল্লেখ্য, বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ পেয়ে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর তামহা সিকিউরিটিজের বাণিজ্য বন্ধ করে ডিএসই। এরপর বিএসইসির অনুরোধে গত ৫ জানুয়ারি হাউসটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হারুনুর রশিদসহ প্রতিষ্ঠান-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।