স্মিতা জান্নাত: মনুষ্যজীবনের চরম সত্য হলো মৃত্যু; আর মানুষ আজন্ম এই মৃত্যুর ভয় নিয়েই জীবন পার করে। কিন্তু যখন দেশের ভবিষ্যৎ বারংবার মৃত্যুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, তখন সেটা শুধু দেশেরই নয় পুরো জাতির জন্য মর্মপীড়াদায়ক। আর বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে করোনা মহামারিকে অতিক্রম করে যখন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতে হয় শিক্ষার্থীদের, তখন এটা শুধুই দেশের জন্য হতাশা নয়, দশের জন্যও যথেষ্ট মর্মান্তিক।
গত বছর শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা আট শতাধিক। ২০২১ সালে প্রথম ১০ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৬৪৯ জন এবং শুধু নভেম্বরে ৫৫ জন। আর ডিসেম্বরে এই হিসাবের তালিকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬ জন। একই বছরে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৮৪ শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছে শুধু মে মাসেই। যেখানে ২০২০ সালে শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৭০৬ জন, ২০২১ সালে সেটা উঠে দাঁড়িয়েছে ৮০০ জনে, আর তার সঙ্গে তো আছে মহামারি কভিড, যা হিসাবের বাইরেও নিয়েছে অগণিত প্রাণ।
কভিড মহামারির সময়ও অপঘাতে মৃত্যু থেকে নিজে ও পরিবারের সুরক্ষার স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ পা দিয়েছিল নতুন বছর ২০২২ সালে। কিন্তু বছরের ছয়টা দিন পার করার পরই বাংলাদেশ আরেকবার সম্মুখীন হলো সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীর মৃত্যুর। গত জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার দৌলতপুর এলাকায় মাদরাসা শিক্ষার্থী আবু বকর নিহত হয় গাড়িচাপায়। ১০ দিন পর ১৭ জানুযারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে টিকা দিতে যাওয়া পথে প্রাণ হারায় দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী হুমায়ুুন। আর তারপরই ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণকাজে ব্যবহƒত ট্রাকচাপায় প্রাণ হারাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারুশিল্প ও শিল্পকলা বিভাগের শিক্ষার্থী মাহমুদ হাবিব হিমেল। ২ ফেব্রুয়ারি শেরপুরের গজনী অবকাশ কেন্দ্রে পিকনিক থেকে ফেরার পথে ট্রলি উল্টে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ১৩ জন এবং তারাও সবাই শিক্ষার্থী। এগুলো সবই গণমাধ্যম থেকে নেয়া হিসাব, কিন্তু এর বাইরে এবং আমাদের অজানা কত শিক্ষার্থীই হারিয়ে গেছে কোনো না কোনো সড়ক দুর্ঘটনার মতো অপঘাতে, যেগুলো এখনও আমাদের অজানা।
শিক্ষা নাগরিকের মৌলিক অধিকার, আর সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাই একটি দেশের উন্নয়নের প্রধান ফটক। আর এই শিক্ষা নিয়েই একজন শিক্ষার্থীর পাশাপাশি তার পরিবার চোখে ধরে রাখে হাজারো স্বপ্ন ও আশা। আর তার সঙ্গে শিক্ষার্থীও চায় কীভাবে দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করবে। শুধু নিজের পরিবার নয়, একজন শিক্ষার্থীর কাছে সমাজের চাওয়া-পাওয়াও কম নয়। আর ঠিক এই একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুও শুধু তার পরিবারের স্বপ্ন ভঙ্গ নয়, সমাজের আশা-আকাক্সক্ষারও জলাঞ্জলি। একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু শুধু একটি জীবনের পরিসমাপ্তি নয় তার সঙ্গে শিক্ষার্থীর পুরো পরিবারের ভবিষ্যৎ চলে যায় অনিশ্চয়তায়। অনেক পরিবার হারায় তাদের একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন। এমন অনেক পরিবার আছে যারা নিজেরা এক বেলা না খেয়ে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগান দেয় শুধু একটি আশায় যে ভবিষ্যতে এই সন্তানই তাদের অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসবে। কিন্তু কিছু অসতর্কতা আর অদক্ষ কর্মীর জন্য তারা এত ত্যাগ বা কষ্টের বিনিময়েও তাদের শেষ অবলম্বন ধরে রাখতে পারে না।
মৌলিক অধিকার শিক্ষা হলে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রথম স্থানে প্রয়োজন নিরাপত্তা। জীবন না থাকলে সব শিক্ষার্থীই ব্যর্থ হয়ে যাবে দেশ গড়তে। সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হলো অতিরিক্ত গতি বা ওভারটেকিং। অসাবধানতার বা অসর্কতার জেরে অন্য গাড়িকে ওভারটেক করা বা ফাঁকা রাস্তা দেখলেই অতিরিক্ত গতি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। অপ্রশস্ত পথও সড়ক দুর্ঘটনার আরও একটি কারণ। আর তার সঙ্গে তো আছেই সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থার অভাব এবং আইন অমান্য করার বিষয়। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো, অদক্ষ চালক ও যান্ত্রিক ত্রুটিসম্পন্ন গাড়ি রাজপথে নামানোও সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সর্বপ্রথম করণীয় হলো নিজেদের সচেতনতা ও নিরাপদ সড়ক। পথচারীদের পদচারী সেতু ব্যবহারে উদ্বুুদ্ধ করতে হবে। দক্ষ চালক নির্ধারণ ও তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা জোরদার এবং চালকের সহকারী দিয়ে যেন কখনও গাড়ি চালানো না হয়, সেদিকে প্রশাসনকে জোর দিতে হবে। চালক নেশাগ্রস্ত হয়ে যেন গাড়ি না চালায়, এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে দুর্নীতি বর্জন করতে হবে, একই সঙ্গে লাইসেন্স দেয়ার আগে চালকের দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই-বাছাই করতে হবে। যান্ত্রিক ত্রুটিসম্পন্ন গাড়ি চালানো পরিহার করতে হবে। সড়ক সংস্কার করতে হবে এবং ট্রাফিক আইন আরও জোরদার করতে হবে। জনসাধারণকে ফুটপাত ও জেব্রাক্রসিং ব্যবহার করতে হবে। এক জরিপে দেখা যায়, ৯১ শতাংশ চালক জেব্রাক্রসিংয়ে অবস্থানরত পথচারীদের আমলেই নেয় না, অন্যদিকে ৮৫ শতাংশ পথচারী নিয়ম ভেঙে রাস্তা পার হয়। তাছাড়া এক সমীক্ষায় বলা হয়, ঢাকা শহরের ৮৪ শতাংশ রিকশাচালক ট্রাফিক আইন ও নিয়ম সম্পর্কে অজ্ঞ।
প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেই থাকে। আর এদের মধ্যে বড় অঙ্কের ভুক্তভোগী হলো শিক্ষার্থীরা। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পর পরিবার থেকেই সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠানো বন্ধ হয়ে যাবে শুধু সড়ক দুর্ঘটনার ভয়ে, যার মাঝে হারিয়ে যাবে অনেক সুপ্ত প্রতিভা, আর দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও সতর্ক হওয়া এবং অন্যদেরও সচেতন করা উচিত। দোষ যারই হোক, দুর্ঘটনায় হারিয়ে যায় কিছু প্রাণ আর তাদের পরিবারের স্বপ্ন।
শিক্ষার্থী, ইংরেজি ভাষা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়