সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা এই বাংলাদেশকে ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি নদীমাতৃক দেশ হিসেবে। শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ৮০০ নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একসময় এই নদ-নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল দেশের অর্থনীতি। নদ-নদীই ছিল জীবন ও জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন। বাংলার সাহিত্য-কবিতায় নদ-নদীর রয়েছে মহিমান্বিত অবস্থান। কিন্তু যন্ত্রচালিত শিল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমরাই তিলে তিলে ধ্বংস করে দিয়েছি নদীগুলোকে। তেমনি মানুষের নির্মমতার জলন্ত উদাহরণ বুড়িগঙ্গা।
বুড়িগঙ্গাকে বলা হয় ঢাকার প্রাণ। বলা হয়ে থাকে টেমসের তীরে যেমন লন্ডন, সেইনের তীরে প্যারিস, দানিয়ুবের তীরে বুদাপেস্ট, তেমনই বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকা। ঢাকার দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গা নদী গঙ্গা বা পদ্মার পুরোনো প্রবাহপথ। আর এটি ধলেশ্বরীর একটি শাখা। পদ্মা নদীর গতি পরিবর্তনের কারণে সে াতধারা অনেক দক্ষিণে সরে গেলে পরিত্যক্ত ক্ষীণ ধারাটি বুড়িগঙ্গা নামে পরিচিতি পায়। অতীত ইতিহাস বলে, এটি ছিল জোয়ার-ভাটা প্রভাবিত একটি নদী। এই নদীটির জোয়ার-ভাটার রূপ দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েছিলেন মোগলরা। অনেকেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন বুড়িগঙ্গার। বুড়িগঙ্গার এই রূপ স্থায়ীভাবে উপভোগ করতে মোগলরা চলে আসেন ঢাকায়। ১৬১০ সালে বুড়িগঙ্গার তীরে স্থাপন করেন ঢাকা নগরী। নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এ নগরীকে আরেকটু রাঙিয়ে দিতে রাতে নদীর তীরে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করেছিলেন মোগল সুবেদার মুকাররম খাঁ। আবার বর্ষাকালে এই নদীতীরের জনপদকে জলমগ্ন ভেনিস নগরীর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতেন অনেক ইউরোপিয়ান বণিক। এমনকি গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকেও বুড়িগঙ্গার স্বচ্ছ পানি ঢাকার সেই আদি জনপদকে বিনা মূল্যেই ভেনিস দেখার ব্যবস্থা করে দিত। সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা টইটম্বুর জল উপচেপড়া বুড়িগঙ্গা নদী দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ নাথ ঠাকুর। নদীর অপরূপ সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে লিখেছেন কবিতা।
মোগল, ব্রিটিশ আর পাকিস্তান আমল পেরিয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ঢাকার বয়সও ছাড়িয়ে গেছে ৪০০ বছর। এই নদীকে কেন্দ্র করে ঢাকা হয়ে ওঠে অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক নগরী। পণ্য আদান-প্রদান থেকে শুরু করে যাত্রী পরিবহন, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সবই বাড়তে থাকে। শিল্পায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে মানুষ এই নদীকে একটু একটু করে ধ্বংস করে দিয়েছে। শিল্পকারখানার বর্জ্য থেকে শুরু করে গৃহস্থালির বর্জ্য সবগুলোর শেষ ঠিকানা এই বুড়িগঙ্গা। প্রতিনিয়ত প্রায় তিন কোটি মানুষের ব্যবহৃত বিষাক্ত পানি ও বর্জ্য এসে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। ঢাকা মহানগর ও কেরানীগঞ্জসহ আশপাশের এলাকার গৃহস্থালি, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের কঠিন বর্জ্যরে একটা বড় অংশ কোনো শোধন ছাড়াই প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। অপরিশোধিত বর্জ্যরে প্রতিটি ফোঁটা এই নদীকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ক্রমাগত দূষণে এর পানি এখন কালচে আকার ধারণ করেছে। কালো রঙের পানি উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। পানি দুর্গন্ধে শ্বাস নেয়াই দুষ্কর। নদীর পানিতে ভাসছে নানা ধরনের ময়লা-বর্জ্য। এর সঙ্গে পলিথিন দূষণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বুড়িগঙ্গা পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম দূষিত নদীতে। নদীর এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য দায়ী ঢাকা নগরীর মানুষ।
আগের দিনে মানুষ একটু প্রশান্তির জন্য বুড়িগঙ্গায় বেড়াতে যেত। নৌকা করে পাড়ি দিত এপার-ওপার। এ সময় নদীর জল দু’হাতে ভরে ছুড়ে দিত আকাশের দিকে, গায়ে মাখত। বালকেরা দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ত নদীর জলে। আর শঙ্খচিলের দল ডানা মেলে আকাশে উড়ে বেড়াত। মাছরাঙাটি ছোঁ মেরে লুফে নিত তার শিকার। মাঝি-মল্লার মুখে ফুটে উঠত গান। জেলেদের মুখে ফুটত হাসি। কী সুন্দরই না ছিল সেসব দৃশ্য! কিন্তু বর্তমানে বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়াই মুশকিল হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে, বেড়ে গেছে বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ। শুধু দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ নয়, পানির বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের যত ধরনের সূচক আছে, সব ধরনের সূচকেই বুড়িগঙ্গার পানি জলজ প্রাণী বসবাসের অনুপযোগী। এই বিষাক্ত পদার্থ আর ভারী ধাতুর অভয়ারণ্যের মধ্যে কোনো জলজ প্রাণীর পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব। মাছ তো দূরে থাক, সাধারণ অন্য কোনো জলজ প্রাণীর অস্তিত্বও চোখে পড়ে না এই নদীতে। শুধু তা-ই নয়, বুড়িগঙ্গার পরিবেশ মানুষের জন্যও ক্ষতিকর।
বুড়িগঙ্গার আজকের এই করুণ পরিস্থিতির জন্য দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ন। এই অপরিকল্পিত নগরায়ন থেকে সৃষ্টি অপরিকল্পিত শিল্পায়ন। যার কারণে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এবং উঠছে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানা। অপরিকল্পিত নগরায়নের পাশাপাশি দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি বুড়িগঙ্গার পরিবেশকে দিনকে দিন দূষিত করেছে। ঢাকা শহরের মানুষের সব বর্জ্য ফেলা হয় এই নদীতে। শহরের ড্রেনগুলোর সঙ্গে যেন এই নদীর আছে এক আন্তঃসম্পর্ক। যার ফলে ড্রেনের মাধ্যমে বর্জ্য সরাসরি নদীতে এসে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। আবার বিভিন্ন শিল্পকারখানার কাঁচামাল সরবরাহ ও যাত্রী পরিবহনের জন্য প্রচুর পরিমাণ নৌযান নদীতে চলাচলের কারণে নৌযানের পোড়া মবিলও বুড়িগঙ্গা দূষণের অন্যতম কারণ। আর এসব কারণেই বুড়িগঙ্গা আজ হুমকিতে। কবিগুরু বেঁচে থাকলে বুড়িগঙ্গার এই করুণদশা দেখে ব্যথিত হতেন। মনের ক্ষোভে ও দুঃখে হয়তো আরেকটি কবিতা লিখতেন।
নদীর তীরে গড়ে উঠেছে ঢাকা শহর, সেই নদী আজ ধ্বংস হয়ে গেছে। নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অনেক শিল্পকারখানা, তার ওপর যুক্ত হয়েছে অবৈধ দখলদারি। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচিয়ে তুলতে দরকার সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনতা। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের জমা হওয়া বর্জ্য অপসারণ করতে হলে হাতে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। উদ্যোগ নিতে হবে ঢাকার অন্য নদীগুলোর সঙ্গে বুড়িগঙ্গার সংযোগ সারা বছর নাব্য রাখার।
মো. আল-মামুন
শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়