নির্মাণ শেষের পথে দেশের সর্ববৃহৎ অবকাঠামো পদ্মা সেতু। চলতি বছর জুনে সেতুটি উদ্বোধনের কথা রয়েছে। এখন সেতুটির নির্মাণপরবর্তী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে সেতু কর্তৃপক্ষ। তাই পদ্মা সেতুর সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক আয়োজনের আজ থাকছে শেষ পর্ব
ইসমাইল আলী: পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে ৯৬ শতাংশ। এপ্রিলের মধ্যে বাকি কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। আর নদীশাসনের কাজ শেষ হবে জুনে। আগামী জুনে সেতুটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে বলে সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে ঠিক কবে নাগাদ সেতুটি উদ্বোধন করা হবে, তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে আগ্রহের শেষ নেই।
সূত্রমতে, পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যান বসানো হয়েছে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। এর পর থেকেই মূলত অপেক্ষার প্রহর গোনা শুরু। তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আগামী ২৩ জুন পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যদিও সেতুটির নিচ তলায় রেললাইন বসানোর কাজ এখনও বাকি রয়েছে। তাই পদ্মা সেতুর সড়ক ও রেল অংশ একই সঙ্গে উদ্বোধন করা যাচ্ছে না। তাই শুধু সড়ক অংশই উদ্বোধন করা হবে ২৩ জুন।
সম্প্রতি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারের উচ্চ মহল। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উপহার হিসেবে ২৩ জুন তারিখটি নির্বাচন করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন সেতু কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আর সে সিদ্ধান্ত অনুসারেই সেতুটি উদ্বোধনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে সেতু কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, আগামী জুনে সেতুটি উদ্বোধন করা যাবে বলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেশ কয়েক মাস আগেই জানিয়েছিল। তখন থেকেই উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। অবশেষে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে ২৩ জুন তারিখটি নির্বাচন করা হয়েছে। সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশে সে অনুযায়ীই প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। জরুরি কোনো পরিস্থিতি তৈরি না হলে এ তারিখই চূড়ান্ত থাকছে।
প্রসঙ্গত, জানুয়ারি পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৯০ দশমিক ৫০ শতাংশ। এর মধ্যে মূল সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ৯৬ দশমিক ২৫ শতাংশ আর নদীশাসন শেষ হয়েছে ৮৮ শতাংশ। সর্বশেষ সংশোধিত পরিকল্পনা অনুসারে, আগামী ২৩ এপ্রিল মূল সেতু এবং ২০ জুন নদীশাসনের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
এদিকে পদ্মা সেতুর টোলহার হবে ফেরি পারাপারের বিদ্যমান চার্জের দেড়গুণ। অর্থ বিভাগ এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবে গত বছরই সম্মতি দিয়েছে। শিগগিরই তা সেতু কর্তৃপক্ষের বোর্ড সভায় অনুমোদন করা হবে। এর পর টোলহারের প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
প্রস্তাবনাটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমানে ফেরিতে শিমুলিয়া-কাওড়াকান্দি রুটে বাইক পারাপারে চার্জ ৭০ টাকা। আর পদ্মা সেতুতে বাইক চলাচলে টোল দিতে হবে ১০০ টাকা। এছাড়া প্রাইভেট কার ও সাধারণ জিপে ফেরি পারাপারের চার্জ দিতে হয় ৫০০ টাকা। পদ্মা সেতুতে এ ধরনের মোটরযানে টোল দিতে হবে ৭৫০ টাকা। তবে প্রাডো, নিশান বা অন্যান্য বিলাসবহুল জিপ ও পিকআপে টোল দিতে হবে এক হাজার ২০০ টাকা। ফেরিতে এ চার্জ ৮০০ টাকা।
এর বাইরে পদ্মা সেতুতে মাইক্রোবাস চলাচলে টোল দিতে হবে এক হাজার ৩০০ টাকা। ফেরিতে এ চার্জ ৮৬০ টাকা। এছাড়া ছোট বাস তথা কোস্টারে এক হাজার ৪০০ টাকা টোল প্রস্তাব করেছে সেতু কর্তৃপক্ষ। আর মাঝারি বাস দুই হাজার টাকা ও বড় বাসে দুই হাজার ৪০০ টাকা টোল প্রস্তাব করা হয়েছে। ফেরিতে এ তিন ধরনের বাসে চার্জ যথাক্রমে ৯৫০ টাকা, এক হাজার ৩৫০ টাকা ও এক হাজার ৫৮০ টাকা।
এদিকে পদ্মা সেতুতে পণ্যবাহী যান চলাচলের জন্য ছোট ট্রাকে (পাঁচ টনের কম) টোল এক হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাকে (পাঁচ থেকে আট টন) দুই হাজার ১০০ টাকা এবং বড় ট্রাকে (আট টনের বেশি) দুই হাজার ৮০০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান ফেরির চার্জ যথাক্রমে এক হাজার ৮০ টাকা, এক হাজার ৪০০ টাকা ও এক হাজার ৮৫০ টাকা। এছাড়া পদ্মা সেতুতে তিন এক্সেলের ট্রাক তথা কাভার্ডভ্যানে টোল দিতে হবে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা, ফেরিতে যা তিন হাজার ৯৪০ টাকা।
এর বাইরে পণ্যবাহী কনটেইনার তথা ট্রেইলারে পৃথক হারে টোল আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে চার এক্সেলের ট্রেইলারে টোল ছয় হাজার টাকা আর চার এক্সেলের বেশি হলে ছয় হাজার টাকার সঙ্গে পরবর্তী প্রতি এক্সেলের জন্য দেড় হাজার টাকা করে অতিরিক্ত টোল যোগ হবে। তবে ফেরিতে বর্তমানে ট্রেইলার পারাপারের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে এটি নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
পদ্মা সেতুর টোল নির্ধারণ কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রাথমিকভাবে ফেরির দেড়গুণ তথা ১৫০ শতাংশ হারে পদ্ম সেতুর টোল নির্ধারণের বিষয়টি নিয়ে কাজ করা হয়। তবে সরাসরি দেড়গুণ করতে হলে ভাঙতি টাকার ঝামেলা এসে পড়বে, তাই রাউন্ড ফিগার হিসেবে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই ক্ষেত্রবিশেষে ১৫০ শতাংশের চেয়ে টোল কিছুটা কম বা বেশি করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর ঋণ পরিশোধ ও মূল্যস্ফীতি এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় প্রতি তিন বছর পরপর টোল হার পুনর্নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে অর্থ বিভাগ তা বাতিল করেছে। মূলত মানুষের সক্ষমতার বিষয়টি মাথায় রেখে তা বাতিল করে অর্থ বিভাগ। এক্ষেত্রে প্রতিবার টোল বৃদ্ধির আগে অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিতে হবে।