ইসমাইল আলী: ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের এলেঙ্গা-হাটিকামরুল-রংপুর অংশটি চার লেনে উন্নীত করা হচ্ছে। যদিও প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরে প্রকল্পটির জমি অধিগ্রহণ শেষ হয়নি। এর মধ্যে দেখা দিয়েছে নতুন সমস্যা। পাওয়া যাচ্ছে না প্রকল্পটির জন্য প্রয়োজনীয় পাথর ও বিটুমিন। ভারতের বিধিনিষেধে পাথর আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। আর প্রয়োজনীয় বিটুমিন সরবরাহ করতে পারছে না ইস্টার্ন রিফাইনারি। ফলে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে।
সূত্রমতে, গত জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পটির অগ্রগতি মাত্র ৪৩ শতাংশ। যদিও পরিকল্পনার ত্রুটিতে প্রকল্প ব্যয় এক দফা বাড়ানো হয়েছে চার হাজার ৭৬৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। তবে চাহিদা অনুযায়ী পাথর ও বিটুমিন না পাওয়ায় প্রকল্প আরও বিলম্বিত হবে। ফলে ব্যয় আরও বেড়ে যেতে পারে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভায় এসব বিষয় উঠে আসে। এতে জানানো হয়, করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রকল্পটির বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়। বর্ডার লকডাউন, আন্তর্জাতিক ফ্রেইট বন্ধ থাকায় নির্মাণসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি আমদানি স্থবির হয়ে পড়ে। প্রকল্পের বিদেশি ঠিকাদার ও পরামর্শকদের প্রকৌশলীদের আগমন বিলম্বিত হয়। এ জন্য ঠিকাদারদের চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে হবে। এসব বাধা পেরিয়ে কাজ শুরু হলেও প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে।
বৈঠকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে প্রথম দুটি হলোÑবিটুমিনের স্বল্পতা ও পাথরের দুষ্প্রাপ্যতা। বিটুমিন প্রসঙ্গে বৈঠকে জানানো হয়, প্রকল্পের সড়ক নির্মাণকাজের জন্য ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিন প্রয়োজন। সড়ক নির্মাণকাজে সাধারণত দেশীয় প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারির বিটুমিন ব্যবহারের ওপর জোর দেয়া হয়। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি সরকার আর্থিকভাবে লাভবান হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ইস্টার্ন রিফাইনারির বিটুমিনের সরবরাহ অপ্রতুল। যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে, তা চাহিদার তুলনায় নগণ্য।
এদিকে এলেঙ্গা-হাটিকামরুল-রংপুর চার লেন নির্মাণ মূলত ভারত ও ভুটান থেকে আমদানিকৃত পাথরের ওপর শতভাগ নির্ভরশীল। আমদানিকৃত বোল্ডার সড়কের বেইজ নির্মাণের জন্য উপযুক্ত আকারে ক্রাশ করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি ভারত সরকারের বিধিনিষেধের কারণে ভুটান ও ভারতের বোল্ডার সরবরাহে অপ্রতুলতা দেখা দিয়েছে।
জানতে চাইলে বৈঠকে সভাপতিত্বকারী সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের সদ্যবিদায়ী প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর শেয়ার বিজকে বলেন, বিটুমিনের সমস্যা সমাধানের জন্য বিপিসির চেয়ারম্যান ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের মহাব্যবস্থাপককে চিঠি দেয়া ও সরাসরি সাক্ষাৎ করা হয়। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের মাধ্যমে জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিবকে চিঠি দেয়া হয়েছে। তারপরও বিটুমিনের সমস্যার সমাধান হয়নি। আর পাথরের সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে। তবে এখনও সমস্যা সমাধান হয়নি। এতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন বিলম্বিত হতে পারে।
এদিকে বৈঠকে বিটুমিন ও পাথরের সংকট ছাড়াও ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন নিয়েও জটিলতা রয়েছে। প্রকল্পটির জন্য ৩২৬ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন। তবে এখন পর্যন্ত ২৬০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। তবে গাইবান্ধার দুটি ও রংপুরের সাতটি প্রস্তাব প্রক্রিয়াকরণে ধীরগতির কারণে প্রকল্পের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এর মধ্যে গাইবান্ধার জমি অধিগ্রহণ বিলম্বের জন্য অতিরিক্ত অর্থ দাবি করেছে ঠিকাদার।
তথ্যমতে, এলেঙ্গা-হাটিকামরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেন নির্মাণ প্রকল্পটি একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) অনুমোদন হয় ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। সে সময় প্রকল্পের কাজ শেষ করার মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২১ সালের আগস্ট। আর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ হাজার ৮৯৯ কোটি এক লাখ টাকা। তবে ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। এতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৬৬২ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ নির্মাণ ব্যয় বেড়ে গেছে ৪০ শতাংশের বেশি। পাশাপাশি প্রকল্পটির মেয়াদও বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর করা হয়েছে।
প্রকল্পটি মোট ১৫টি প্যাকেজে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১৩টি প্যাকেজের আওতায় দুই পাশে ধীরগতির যানবাহনের জন্য পৃথক লেনসহ চার লেন নির্মাণ করা হচ্ছে মহাসড়কটি। এ ছাড়া দুই হাজার ৬৩৫ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৩টি ফ্লাইওভার (এলেঙ্গায় এক হাজার ৫৩৮ দশমিক ৬১ মিটারের একটি, কড্ডার মোড়ে ৩৯৫ দশমিক ৬৪ মিটারের একটি ও গোবিন্দগঞ্জে ৭০০ দশমিক ৭৫ মিটারের একটি), ৪১১ মিটার দীর্ঘ ১টি রেলওয়ে ওভারপাস, ১ হাজার ৪৬১ দশমিক ৩৯ মিটার দীর্ঘ ২৬টি ছোট-মাঝারি সেতু, ১ হাজার ১০২ মিটার দৈর্ঘ্যরে ১৬১টি কালভার্ট, ৩৯৭ মিটার দৈর্ঘ্যরে ১১টি ফুটওভারব্রিজ, ১৯৫ মিটার দীর্ঘ ৩৯টি আন্ডারপাস এবং হাটিকামরুলে দেড় কিলোমিটারের ১টি ইন্টারচেঞ্জ নির্মাণ করা হবে। অন্য দুই প্যাকেজের আওতায় সওজের কর্মচারীদের জন্য আবাসন নির্মাণ ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নসহ রোড অপারেশন ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হবে।
