দুদকের মামলার আসামি ও তৃতীয় শ্রেণিপ্রাপ্তরা পেলেন পদোন্নতি!

রহমত রহমান: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮ জন পরিচালক পদোন্নতির ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। পদোন্নতিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৫ জন দুদকের মামলার আসামি। তাদের চারজন ওই মামলায় জেল খেটেছেন। মামলা এখনও চলমান। জেল খাটার পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। উল্টো পুরস্কার হিসেবে পরিচালক পদে পদোন্নতি দিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, পদোন্নতির ক্ষেত্রে তৃতীয় বিভাগ গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু শিক্ষাজীবনে তৃতীয় শ্রেণি রয়েছে এমন তিনজনকে পরিচালক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।

পদোন্নতিতে তিন সদস্যের যে যাচাই কমিটি করা হয়েছেÑতার মধ্যে দুজন দুদকের মামলার আসামি, খেটেছেন জেল। নামমাত্র বিজ্ঞপ্তি, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে পছন্দের লোক বসাতে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে পদোন্নতি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। পরিচালক পদে পদোন্নতির প্রতিটি খাতে অনিয়মের বিষয়টি নিয়ে উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। এছাড়া পদোন্নতি বঞ্চিত একজন সম্প্রতি উচ্চ আদালতে অনিয়মের বিষয়টি সামনে এনে রিট করেছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

অনিয়মের বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘নিয়মের ব্যত্যয় করে একটি কাজও করা হয়নি। পদোন্নতিপ্রাপ্তরা সবাই কমবেশি ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। এমন না যে, আমি এসে হঠাৎ করে তাদের পরিচালক করেছি।’ তিনি বলেন, ‘কারও অনেক দিনের অভিজ্ঞতা, কারও হয়তো অল্প দিনের অভিজ্ঞতা। যেমনÑমানবসম্পদ উন্নয়ন বা অনলাইন মনিটরিংয়ে পদগুলো নতুন সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে অনেক দিনের অভিজ্ঞতার দরকার নেই। পরে সেখানে ভারপ্রাপ্ত দেয়া হয়েছে, যাদের পদোন্নতি দিয়ে নিয়মিত করেছি। এছাড়া অন্যান্য প্রতিযোগী আবেদন করে বোর্ডের মুখোমুখি হয়েছেন। এর মধ্যে বিন্দুমাত্র কোনো ব্যত্যয় আছে বলে আমার জানা নেই। এরপরও যদি কেউ আমার কাছে অনিয়মের নথি উপস্থাপন করে, আমি তা সানন্দে গ্রহণ করে, তা যথাযথ বডিতে আলোচনা করব।’

তিনি বলেন, ‘একটি উকিল নোটিস পেয়েছি। পদোন্নতিপ্রাপ্তরা ইতোমধ্যে যোগদান করেছেন। আদালতের নির্দেশনা যদি আসে, এটা কার্যকর করা যাবে না, তখন তা অনুসরণ করব। তবে আমাদের দিক থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিছুই ছিল না।’

পদোন্নতিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৫ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা চলমান। কারাভোগের পরও কীভাবে পদোন্নতি পেলেনÑএমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘দুদকের অভিযোগ বা অন্য মামলা থাকতে পারে। পদোন্নতি-সংক্রান্ত দুদকের কোনো আপত্তি আছে বলে আমার জানা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মামলা রয়েছে। সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে মামলা আছে। এর জন্য কি কাজ বন্ধ রাখবেন? পদোন্নতিতে কোনো জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘিত হয়নি।

অভিযোগে বলা হয়েছে, পরিচালক হিসেবে পদোন্নতিতে দরখাস্ত আহ্বান করে ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর ও ২৪ নভেম্বর দুই দফায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞপ্তি জারি করে। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার বা সমমানের কর্মকর্তা হতে পরিচালক পদে পদোন্নতি দেয়ার জন্য এ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়।

সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-উর-রশিদ অবসরের আগে কয়েকজনকে ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব দিয়েছেন। তাদের স্থায়ী করতেই এ সাজানো বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে ‘সংশ্লিষ্ট কাজে বাস্তব অভিজ্ঞতার’ শর্ত দেয়া হলেও তার কিছুই যাচাই করা হয়নি। অভিজ্ঞতা নেইÑএমন তিনজন কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন। যেমন এইচএম তায়েহীদ জামাল (শারীরিক শিক্ষা), মো. আতাউর রহমান (জনসংযোগ) ও হোসনে আরা বেগম (আঞ্চলিক কেন্দ্র সমন্বয়) এ তিনজনকে ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে ২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর দায়িত্ব দেয়া হয়। মাত্র ২৭ দিনের অভিজ্ঞতায় তাদের পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়।

আরও বলা হয়, আবেদন যাচাইয়ে তিন সদস্যের কমিটি করা গঠন করা হয়। ওই কমিটির তিনজনের মধ্যে দুজন দুর্নীতির মামলার আসামি, করেছেন কারাভোগ, মামলা এখনও চলমান। তারা হলেনÑরেজিস্ট্রার মোল্লা মাহফুজ আল হোসেন ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বদরুজ্জামান।

অভিযোগ উঠেছে, আগের উপাচার্যের ইশারায় বর্তমান উপাচার্যের তত্ত্বাবধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ প্রহসনমূলক কমিটি করেছে।

অভিযোগের বিষয়ে রেজিস্ট্রার মোল্লা মাহফুজ আল হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, পদোন্নতিপ্রাপ্তদের কেউ দুদকের কারাভোগ করেনি। চার্জশিটও হয়নি। তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে। অভিজ্ঞতা ছাড়া ও তৃতীয় শ্রেণিপ্রাপ্ত তিনজনকে নিয়ম ভেঙ্গে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, এটা ভুল তথ্য। তফসিল অনুযায়ী পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন ও অনিয়মের অভিযোগ রিট হয়েছেÑএ বিষয়ে রেজিস্ট্রার বলেন, সব আইন অনুযায়ী হয়েছে।

এ বিষয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বদরুজ্জামান শেয়ার বিজকে বলেন, আমাদের বিজ্ঞপ্তিতে যে ক্রাইটেরিয়া দেয়া আছে, তা যাচাই করতে বলেছে। এর বাইরে বাড়তি কিছু যাচাই করতে বলেনি। নিয়োগ দিয়েছে প্রশাসন।

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে তৃতীয় বিভাগ গ্রহণযোগ্য নয়। অথচ পদোন্নতিপ্রাপ্ত তিনজনের শিক্ষাজীবনে তৃতীয় বিভাগ রয়েছে। তিনজন হলেন পরিচালক (শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা), পরিচালক (অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা) ও পরিচালক (তথ্য ও সেবা)। তাদের শিক্ষাজীবনে একটি করে তৃতীয় বিভাগ রয়েছে। এর আগেও একই নিয়ম লঙ্ঘন করে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে পদোন্নতি দেয়া হয় বদরুজ্জামানকে।

আরও বলা হয়, চাকরি বিধি অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী ফৌজদারি ও দুর্নীতির মামলার অভিযুক্ত আসামি হলে সাময়িক বরখাস্ত হবেন। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত আসামি, এমন কি গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করার পরও কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করেননি। উল্টো পুরস্কার হিসেবে পদোন্নতি প্রদান করেছে। পদোন্নতিপ্রাপ্ত ১৮ জনের মধ্যে ৫ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের চারটি পৃথক মামলা চলমান। এ মামলায় ২০১৭ সালে গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেছেন পরিচালক (শারীরিক শিক্ষা) এইচএম তায়েহীদ জামাল, পরিচালক (মানবসম্পদ উন্নয়ন ও শুদ্ধাচার সেল) জয়ন্ত ভট্টাচার্য্য, পরিচালক (আইনবিষয়ক) মো. সিদ্দিকুর রহমান, পরিচালক (শিক্ষক প্রশিক্ষণ) মো. হাছানুর রহমান এবং পরিচালক (জনসংযোগ) মো. আতাউর রহমান। এর আগে দুদকের একই মামলার আসামি ও কারাভোগকারী বর্তমান রেজিস্ট্রার মোল্লা মাহফুজ আল হোসেন ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বদরুজ্জামানকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।

আবার পরিচালক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দপ্তর-সংক্রান্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হয়। কিন্তু তিনজনকে যোগ্যতা ছাড়াই পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে পরিচালক (শারীরিক শিক্ষা), পরিচালক (আইনবিষয়ক) ও পরিচালক (জনসংযোগ)Ñএই তিনজনের সংশ্লিষ্ট কোনো যোগ্যতা নেই।

অভিযোগে বলা হয়, পদোন্নতির ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার নিয়ম মানা হয়নি। সিনিয়র কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে জুনিয়র কর্মকর্তাদের পরিচালক পদে এমন কি পঞ্চম গ্রেড থেকে সরাসরি তৃতীয় গ্রেডে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তা ও  উপ-রেজিস্ট্রার একেএম ফিরোজের যোগ্যতা থাকা এবং সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়নি। তার থেকে জুনিয়র ছয়জনকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০