দেশে ক্যানসার চিকিৎসায় সরকারের যুগান্তকারী উদ্যোগ

মাইদুল ইসলাম প্রধান: বিষয়টি এখন সবাই জানেন যে, পরিবারে ক্যানসার-আক্রান্ত কোনো রোগী থাকা মানে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে করতে সেই গোটা পরিবারটিরই হতদরিদ্র পরিবারের কাতারে চলে যাওয়া। অনেক ভালো চিকিৎসার পরও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তিটি শেষমেশ মারাই যান। আর আক্রান্ত পরিবারটি একদিকে সীমাহীন পারিবারিক কষ্টে থাকে, অন্যদিকে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে গোটা পরিবারটিই দিশাহারা ও বেসামাল হয়ে পড়ে।

সত্যিকার অর্থেই চিকিৎসাক্ষেত্রে ক্যানসার একটি দুরারোগ্য রোগ্য। এই রোগটি শরীরে বাসা বাঁধলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শেষ পর্যায়ে ধরা পড়ে। একেবারে শেষ পর্যায়ে ধরা পড়ার কারণে বেশিরভাগ রোগীই মারা যায়। অথচ আক্রান্ত হওয়ার শুরুতেই যদি পরীক্ষার মাধ্যমে রোগটি নির্ণয় করা সম্ভব হয়, তাহলে খুব অল্প খরচে অধিকাংশ রোগীই সুস্থ হতে পারে।

দেশে মোটামুটি ভালো মানের ক্যানসার চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়, এরকম হাসপাতাল আছে খুব হাতে গোনা অল্প কিছু। এই হাসপাতালগুলোর অধিকাংশই ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় দিন দিন রোগীর চাপ বেশি হচ্ছে এবং রোগীরা ক্যানসার চিকিৎসা করতে বিদেশমুখী হয়ে র্অনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। দেশে বেসরকারি কিছু হাসপাতালে মানসম্মত ক্যানসার চিকিৎসা দেয়া হলেও তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় দেশের অধিকাংশ মানুষ এসব হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারে না।

অন্যদিকে পরিসংখ্যান বলছে, দিন যতই যাচ্ছে দেশে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ততই বেড়ে চলেছে। প্রতিবছর গড়ে দেড় থেকে দুই লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে এক থেকে দেড় লাখ আক্রান্ত মানুষই এই রোগে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে। অন্যদিকে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে বছরে বছরে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো নিঃস্ব ও দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের (আইএআরসি) সাম্প্রতিক প্রকাশিত অনুমিত হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর এক লাখ ৫০ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে মারা যায় এক লাখ আট হাজার এবং এই সংখ্যা প্রতিবছর বেড়েই চলছে। এই সংস্থার মতে, বাংলাদেশে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর হার প্রতি লাখে ১০৫ দশমিক ৭ এবং মৃত্যুহার প্রতি লাখে ৭৭ দশমিক ১।

অনানুষ্ঠানিক আরেক জরিপে দেখা গছে, এই অনুমিত ক্যানসার রোগীদের এক-তৃতীয়াংশ দেশের স্বীকৃত চিকিৎসাসেবার আওতায় আসে। বাকিদের একটা বড় অংশ বিদেশে চিকিৎসা নিচ্ছে, কিংবা নানা অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থার আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে ক্যানসার নির্ণয় ও চিকিৎসাসেবার বাইরে থেকে যাচ্ছে বিপুলসংখ্যক রোগী। গত দুই দশকে দেশে সরকারি খাতে ক্যানসার চিকিৎসার আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটেছে লক্ষণীয়ভাব। ঢাকার মহাখালীতে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা প্রথমে ৫০ থেকে ৩০০-তে উন্নীত করা হয়েছে এবং এরপর আরও ৫০০ শয্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে, যেখানে রেডিওথেরাপির আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযুক্ত হয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলজে ও ঢাকার বাইরে বগুড়ায় শহিদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেডিওথেরাপির সর্বাধুনিক লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিন সংযুক্ত হয়ছে। পুরোনো আটটি বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গভাবে সবগুলোয় ক্যানসার বিকিরণ চিকিৎসা ও কেমোথেরাপির ব্যবস্থা চালু নেই। বেসরকারি খাতে কয়েকটি বড় হাসপাতালে রেডিওথেরাপিসহ ক্যানসার চিকিৎসা চালু করা হয়েছে, যেখানে অনেক সচ্ছল রোগী চিকিৎসা নিতে পারছে, যা সাধারণ মানুষের চিকিৎসাপ্রাপ্তির নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে। একমাত্র জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কোনো বিশেষায়িত ক্যানসার সেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। এখন পর্যন্ত ক্যানসার চিকিৎসাব্যবস্থা রাজধানীকেন্দ্রিক। তাই সরকারিভাবে চিকিৎসার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হয়। উপরন্তু ক্যানসার চিকিৎসা ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী সমর্থ না থাকলেও বাধ্য হয়ে বিদেশি কিংবা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। ক্যানসার নির্ণয় ও চিকিৎসা সুবিধা রাজধানীকেন্দ্রিক হওয়ায় এবং ক্যানসার রোগ সম্পর্কে জনগণের অজ্ঞতা ও অসচেতনতায় রোগ নির্ণয় বিলম্বিত হয়, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল পাওয়া সম্ভব হয় না।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যানসার নির্ণয়ের এক বছররে মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ রোগী মারা যায়, কিংবা ভয়াবহ আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়। এ অবস্থায় দেশের অধিকাংশ মানুষের ভৌগোলিক ও আর্থিক অবস্থার নাগালের মধ্যে ক্যানসার সেবা পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ প্রয়োজন। ক্যানসার রোগীর সঠিক পরিসংখ্যান এবং জনগোষ্ঠীভিত্তিক বা পপুলশেনভিত্তিক ক্যানসার রেজিস্ট্রির মাধ্যমে ক্যানসারে আক্রান্তের হার, মৃত্যুহারসহ গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত পাওয়া সম্ভব, যা সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। ২০০৪ সালে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউিট হাসপাতালে ও ১৯টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যানসার নিবন্ধন কার্যক্রম স্বল্পপরসিরে শুরু হয়েছে। কিন্তু জনগোষ্ঠীভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধনের উদ্যোগ নেয়া ছাড়া উল্লিখিত তথ্য-উপাত্ত পাওয়া সম্ভব নয়।

ক্রমান্বয়ে ক্যানসার চিকিৎসায় একদিকে ঢাকার ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ কমানোর তাগিদ, অন্যদিকে এই ক্যানসার চিকিৎসায় সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে দরিদ্র হয়ে যাওয়া ঠেকানোর বিষয়টি সরকারের মাথাব্যথা হয়ে দেখা দেয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী জাহিদ মালেক ২০১৮ সালে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে ধরলে তিনি ক্যানসার চিকিৎসায় দেশব্যাপী চিকিৎসাসেবা ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে নির্দেশনা দেন। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লাগে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। ক্যানসার চিকিৎসার গুরুত্ব অনুধাবন করে দেশের আটটি বিভাগেই আটটি ১৫ তলাবিশিষ্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়। ক্যানসারের পাশাপাশি সেখানে কিডনি, লিভার ও ডায়ালাইসিস সুবিধা রাখার জন্যও আলাদা ব্যবস্থা রাখার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ক্যানসার চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি অবশেষে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে প্রকল্প আকারে বাস্তবায়ন করতে কাজ শুরু হয়। কাজ শেষ করা বা লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সময় নির্ধারণ করা হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত। প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় অনুমোদিত হয় এবং ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর প্রকল্পটি প্রশাসনিক অনুমোদন লাভ করে। প্রকল্পটির সার্বিক উদ্দেশ্য হচ্ছেÑসারাদেশে ক্যানসার রোগে আক্রান্ত বিশাল জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা; সূচনাতেই ক্যানসার রোগ নির্ণয় এবং সময়মতো ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা; ক্যানসার চিকিৎসা সেবা সম্প্রসারণ ও বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা; ক্যানসার চিকিৎসাসেবায় বৈদেশিক নির্ভরতা কমিয়ে আনা, পক্ষান্তরে

বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করা; দেশে ক্যানসার চিকিৎসাসেবা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা।

সর্বোপরি আট বিভাগে আটটি উন্নত মানের ক্যানসার, কিডনি ও লিভার চিকিৎসা হাসপাতাল নির্মাণ নিঃসন্দেহে সরকারের একটি সুদূরপ্রসারী ও ফলপ্রসূ চিন্তার ফসল হয়ে দেখা দেবে বলে দেশের বিজ্ঞজনেরা মনে করছেন। হাসপাতালগুলোর নির্মাণকাজের অগ্রগতি এখন একেবারে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাসপাতালগুলোর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেছেন। আশা করা যাচ্ছে, নির্ধারিত সময়েই হাসপাতালগুলো কার্যক্ষম হয়ে উঠবে। হাসপাতালগুলোর প্রতিটিতেই প্রথম অবস্থায় অন্তত ১০০টি করে ক্যানসার শয্যার মাধ্যমে চিকিৎসাসেবার ব্যাবস্থা থাকবে। এর পাশাপাশি সমহারে কিডনি ও লিভার চিকিৎসার জন্যও শয্যা থাকবে। এগুলো প্রস্তুত হয়ে গেলে ক্যানসার চিকিৎসায় ঢাকার ওপর চাপ অনেকাংশই কমে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সাধারণ মানুষ ঢাকায় এসে চিকিৎসা করাতে অতিরিক্ত টাকা খরচ করার পাশাপাশি চিকিৎসা-সংক্রান্ত ভোগান্তির হাত থেকেও বেঁচে যাবেন। হাসপাতালগুলো চালু হলে একদিকে দ্রুততার সঙ্গে রোগটিকে প্রথম পর্যায়েই নির্ণয় করা যেমন সহজ হবে, অন্যদিকে চিকিৎসাসেবায় জটিল ও ভীতির এই রোগটির চিকিৎসায় দেশের প্রান্তিক মানুষ অনেকটাই স্বস্তির শ্বাস নিতে শুরু করবে।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০