বাংলা ভাষার মর্যাদা কতটুকু দিতে পেরেছি

প্রসেনজিৎ চন্দ্র শীল: ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা পরম-শ্রদ্ধায় বিনম্র স্মরণ করি ভাষাশহিদদের, যাদের বুকের তাজা রক্তে বায়ান্নতে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’এ আন্দোলন শুধু ভাষার জন্য আন্দোলন ছিল না, ছিল বাঙালির অস্তিত্বের আন্দোলন। ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির কাছে আত্মত্যাগ, শ্রদ্ধা ও অহংকারের মাস। বাঙালি জাতির কাছে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে প্রেরণার মাস ফেব্রুয়ারি।

যে ভাষার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে বাঙালিকে। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে আনা হয়েছিল একটি ভাষা, যার নাম বাংলা ভাষা। পৃথিবীর ইতিহাসে এটিই একমাত্র ঘটনা, যে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য এত মানুষ প্রাণ দিয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা মাতৃভাষার চেতনায় উজ্জীবিত হই। বাকি ১১ মাস ঘুম পাড়িয়ে রাখি মাতৃভাষার চেতনাকে। ভুলে যাই আমরা আমাদের অতীতের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও স্মৃতিকে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে এ পর্যন্ত ৭০টি বছর পেরিয়ে গেল। আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উৎসব চলছে। আত্মমূল্যায়ন করলে দেখা যায়, বাংলা ভাষার প্রতি যথার্থ মূল্যায়ন করতে আমরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি।

বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা এবং একইসঙ্গে দাপ্তরিক ভাষা। সব সরকারি অফিস ও কর্মপ্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষায় কার্যক্রম সম্পন্ন হচ্ছে। আমরা বাংলায় কথা বলি। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে মাসব্যাপী বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়ে আসছে। জাতীয় পর্যায়ে অনন্য অবদানের জন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একুশে পদক প্রদান করা হচ্ছে। বাংলা ভাষার উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি কাজ করে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ভাষাকে যে মর্যাদা দেয়া হয়েছে, আমরা ব্যক্তি পর্যায়ে বাংলার প্রতি কি ততটুকু শ্রদ্ধাশীল? বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের দায়দায়িত্ব কি যথাযথভাবে পালন করছি?

শিক্ষিত তরুণ সমাজের কাছে আজ বাংলার গুরুত্ব নেই; কারণ বাংলা ভাষার জ্ঞান ও দক্ষতা তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে না। সেটা করে ইংরেজি ভাষা। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইংরেজির প্রাধান্য শুধু বাংলাদেশের বাস্তবতা নয়, এটি একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা। আমরা স্বাধীন দেশ পেলাম কিন্তু আজও আমরা নিজের ভাষার চর্চা না করে অপসংস্কৃতিতে নিমজ্জিত। এই অপসংস্কৃতি, দেশপ্রেমহীনতা ও দুর্নীতি দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। আমরা এখন বাংলাদেশ ছাড়ছি। কিন্তু তার ফলে ফরাসি, জার্মান, রুশ, চীনা, জাপানি ইত্যাদি ভাষাভাষী মানুষের কাছে নিজ নিজ মাতৃভাষার গুরুত্ব, মর্যাদা, সমাদর কিছুই কমছে না। তাহলে বাঙালির কাছে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা ও সমাদর কেন কমেছে এবং আরও কমে যাচ্ছে?

বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩৮ থেকে ৪০ কোটি বাংলাভাষী মানুষ। আমরা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা বাংলা চাই; অথচ নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভালো বাংলা বই প্রকাশ করি না। সবসময়ই প্রাচ্যের ভাষাকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। যেখানে অন্যান্য দেশ নিজেদের মাতৃভাষাকেই প্রাধান্য দিয়ে নিজ নিজ দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যথাসম্ভব প্রাধান্য দিয়ে আসছে, সেখানে আমরা নিজ ভাষার অসম্মান করতে দ্বিধা করছি না।

১৯৪৮ সালের প্রথম ভাষা আন্দোলনের সময়েই ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের কনভোকেশনের ভাষণে পাকিস্তানের বড় লাট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হবেÑকথাটা উচ্চারণের পরপর ছাত্রদের উচ্চকণ্ঠের প্রতিবাদ ‘না, না’ ধ্বনিত হয়েছিল। মনে হলো, বাংলা মায়ের সন্তানরা বুকে আঘাত পেয়েছে আমরা ’৫২-তে রুখে দাঁড়ালাম। সেই চেতনার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনলাম ১৯৭১ সালে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানই হয়েছে সেই জাতির মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় জীবনের ভাষা হিসেবে গ্রহণ ও জীবিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করার মাধ্যমে। কিন্তু আমরা আজও নিজেদের মায়ের ভাষার যথাযোগ্য সর্বস্তরের ব্যবহার নিশ্চিত করে উঠতে পারিনি। বাংলার থেকে ইংরেজি ভাষার কদর বেশি দিচ্ছি।

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে নেমেছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। প্রাণ দিয়েছিলেন রফিক, সফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে। তাদের মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলা ভাষা।

মাতৃভাষার জন্য এমন সাহসী মহান আত্মত্যাগ আজ সারাবিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। বাঙালি জাতি গৌরবের মহিমা নিয়ে বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

আজ এত বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে বারবার। চারদিকে আজ পশ্চিমা এবং হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের ছড়াছড়ি। তরুণ সমাজ পশ্চিমা অশ্লীল সংস্কৃতিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। যে রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে বাংলা ভাষার ব্যবহার করার কথা ছিল, সেখানে আজ সিংহভাগ ব্যবহার করা হচ্ছে ইংরেজি ভাষা। এমনকি বাংলাকে ইংরেজি এবং হিন্দির সঙ্গে মিশিয়ে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ও ব্যবহারে যে স্বপ্ন নিয়ে রক্ত দিয়েছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা, তাদের সে স্বপ্ন যেন আজ ক্রমেই ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, আইন-আদালত, গণমাধ্যমসহ সর্বত্রই উপেক্ষিত বাংলা। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষত উচ্চশিক্ষায় বাংলা ব্যবহার নেই বললেই চলে। অথচ ভাষাগত দিক থেকে বাংলা যথেষ্ট সমৃদ্ধিশালী। তথাপি বাংলা যেন নিজভূমে পরবাসী।

যে মাতৃভাষা বাংলাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে গিয়ে এ জাতির বীর সন্তানরা তাদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছিল, সে মাতৃভাষা বাংলাকে এভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা মেনে নেয়া যায় না। বাংলা ভাষার অবহেলার অবসান ঘটুক। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে এটাই আমাদের আকাক্সক্ষা। বাংলা ভাষার চেতনা উজ্জ্বল করে তুলতে সবার উদ্দেশ্যে আহ্বান জানাই, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের প্রতি। আর এই হোক আমাদের শপথ। বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে ব্যবহার এবং প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

ঢাকা কলেজ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০