ইশারা ভাষার প্রসারে সম্মিলিত প্রয়াস জরুরি

মানবজাতির আত্মপ্রকাশের একমাত্র মাধ্যম ভাষা। ভাষা মনুষ্যজাতির মতপ্রকাশের পথও দেখায়। সময়ের পরিক্রমায়, একাধারে অনেক ভাষার উন্নয়ন, প্রসার কিংবা প্রসার স্থবির হয়ে গিয়েছে। নতুবা প্রসার সংকটে অকাল সে াতে হারিয়ে গিয়েছে। বর্তমানে, বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধীর ইশারা ভাষার প্রসারেও স্থবিরতা দেখা গিয়েছে। 

বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধীরা যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ইশারা ভাষা ব্যবহার করে থাকে। একে ইংরেজি পরিভাষায় ‘ঝরমহ খধহমঁধমব’ বলা হয়। ইশারা বা সাংকেতিক ভাষা হচ্ছে হাত ও বাহুর শারীরিক নড়াচড়ার মাধ্যমে যোগাযোগের মাধ্যম। ইশারা ভাষা সম্পূর্ণরূপে কথ্য ভাষা থেকে কাঠামোগতভাবে আলাদা। তবে ইশারা ভাষা যেহেতু হাত ও বাহুর সাহায্যে হয়ে থাকে। তাই এক্ষেত্রে আমাদের উচ্চারণ বা ব্যাকরণ শেখার কোনো জটিলতা নেই।

ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব দ্য ডেফ-এর তথ্য মতে, বিশ্বে ৭ কোটিরও বেশি বধির লোক আছেন। তাদের ৮০ শতাংশেরও বেশি উন্নয়নশীল দেশে বাস করে।

বাংলাদেশ ২০১২ সালে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় ৭ ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘বাংলা ইশারা ভাষা দিবস’হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।

বাক-শ্রবণশক্তি না থাকায় বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের মাতৃভাষা থাকলেও ইশারা ভাষায় মতবিনিময় করে থাকে। ইশারা ভাষার মাধ্যমে তারা অন্যের সঙ্গে মনের ভাব প্রকাশে প্রশান্তি খুঁজে পেতে চায়। তাদের জীবনের নানা ছন্দের প্রকাশ ও তার পতনের প্রকাশ ঘটে এই ভাষার মাধ্যমে। কিন্তু বাংলাদেশে ইশারা ভাষার ব্যবহার বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী প্রশিক্ষক, ডাক্তার, পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই অধিকাংশ সময় দেখা যায়, অন্যরা ইশারা ভাষা না জানায়  তার সঙ্গে পরিচয় বা মতবিনিময়েরও তেমন আগ্রহ দেখান না। অনেক সময় কথা বলতে ও কানে শুনতে না পারায় তারা মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে এ পরিস্থিতিগুলো তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

শুধু এসব ক্ষেত্রেই নয়, বাংলাদেশে সীমিতসংখ্যক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাদাতার পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় তাদের সঙ্গে সরকারি যেকোনো হাসপাতাল কিংবা প্রতিষ্ঠানে সহযোগিতা প্রাপ্তিতে সেখানে দো-ভাষী না থাকায় দো-ভাষী নিয়ে যেতে হচ্ছে। ফলে অনেক সময় তাদের হয়রানি শিকার হতে হচ্ছে। পাশাপাশি  বিটিভিসহ অন্যান্য টেলিভিশন চ্যানেলের প্রধান সংবাদে ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ইশারা ভাষা উপস্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হলেও এখনও সামগ্রিকভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।

তাদের নিরক্ষরতা দূরীকরণে, শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমাজসেবা অধিদপ্তর ৭টি শ্রবণপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয় পরিচালনা করছে। তবে তা সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে দেশের সম্পদ হিসেবে দেশের অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখার দৃষ্টিপটে তাদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জেলাভিত্তিক পর্যায়ে সংখ্যা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। সুচিকিৎসা নিশ্চিতে দেশের বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা সুবিধার জন্য পৃথক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় সরকারি-বেসরকারি তৎপরতা বাড়ানো প্রয়োজন।

সাংস্কৃতিক বিনোদনের দিক থেকে, টেলিভিশন অনুষ্ঠানগুলোতে বক্তার কথাগুলোর বাংলা টাইটেল ব্যবহার করে তাদের অনুষ্ঠান উপভোগে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। 

সর্বোপরি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ এর বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশ ও জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে তাদের অবহেলা না করে দেশের সর্বস্তরের জনগণের জন্য বাংলা ইশারা ভাষা শেখা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। যেহেতু ইশারা ভাষা শিক্ষার কোনো জটিলতাও নেই, সেহেতু সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। একই সঙ্গে ইশারা ভাষার ব্যবহার ও প্রসারে দেশের গণমাধ্যমগুলোর সহযোগিতাও একান্ত কাম্য। বস্তুত সম্মিলিত উদ্যোগই পারে ইশারা ভাষা প্রসারের সংকটকাল অতিক্রম করতে।

সুরাইয়া

শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০