জাফরুল ইসলাম: বর্তমান বিশ্বকে বলা হয় আধুনিক বিশ্ব। পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে পৌঁছেছে এ অবস্থায়। ইতিহাস বলে, প্রাচীন পৃথিবী বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, তখন এমন ছিল না। আবার এই পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষজন ছিল তেমনই অসভ্য। কিন্তু সময় পরিবর্তন হয়েছে, পরিবর্তন এসেছে পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষের। একসময় যে মানুষ অসভ্য ছিল, ছিল তার বসবাস পশু-পাখির সঙ্গে, সেই মানুষ আজ সভ্য। তাদের পরিবর্তন এসেছে, তারা আজ আধুনিকতার বুলি শোনায়। যেহেতু মানুষ সভ্য হয়েছে সেহেতু তার সবকিছুতেই সভ্যতার লক্ষণ দেখা যাবে এটাই স্বাভাবিক। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় সভ্য মানুষ আজও অসভ্য কিছু কর্ম সম্পাদন করে, যাতে আধুনিক যুগের মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে ধিক্কার দিতে মন চায়। অসভ্য এক কার্য সম্পাদিত হয়েছে ভারতের কর্ণাটকে হিজাব বিতর্ক। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল আন্তর্জাতিক মহলেও এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ভারতকে বলা হয় হাজারো ধর্মের আবাসভূমি। কারণ আমরা জানি এই ভারতে প্রাচীনকালে আর্য ধর্মের কাহিনী। সেখান থেকে সুলতানি শাসন আমলে ভারতে ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রচার-প্রসার হয়। হিন্দু ধর্মের একক আধিপত্য, হিন্দুদের মধ্যে বিভক্ত ছিল সেই ধারাবাহিকতায় শোষিত শ্রেণি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এরপর ১৭৫৭ সালে ইংরেজরা শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করার পর খ্রিষ্টান পাদ্রিদের মাধ্যমে খিষ্টানদের বা খ্রিষ্টান ধর্মের প্রচারকাজ সম্পাদিত হয়। নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করা হয়। গৌতম বুদ্ধ ধর্ম প্রচার করে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করে। ধর্মের দিক দিয়ে ভারত বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বিভক্ত, সেই প্রাচীনকাল থেকেই। তাই এসব ধর্মের ধারাবাহিকতার অবস্থানও এখনো রয়েছে। একক কোনো ধর্মের দেশ ভারত নয়, সেটা যুগ যুগ ধরে দেখে আসছে গোটা বিশ্ব। কিন্তু হঠাৎ যদি পরিবর্তন করার চিন্তা করা হয় তখন সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা জানি ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনে প্রচারণা প্রধান বিষয় ছিল সাম্প্রদায়িকতা অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদী। সাম্প্রদায়িকতার পরিণতি কী হতে পারে সেটা ১৯৪৭ সালে যখন দেশ ভাগ হয়েছে, তখন সবাই দেখেছে। ভারতবর্ষে দুই অঞ্চলের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা আজও ইতিহাস পাঠ করার মাধ্যমে জানা যায়। সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় কত সাধারণ মানুষের জীবন ঝরে গেছে, সেটার সঠিক পরিসংখ্যান আজও জানা যায় না। এমন ইতিহাস রচনা হয়েছে যেখানে দেখা যায়, ট্রেন ভরে শুধু লাশ আর লাশের গন্ধে চারপাশে ভরে থাকত। দেশভাগ পরবর্তী সময় ভারতের শাসকদের প্রচেষ্টায় সাম্প্রদায়িক অবস্থানের অবসান ঘটে। মহাত্মা গান্ধীর জীবনের বিনিময়ে এই সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার পর আজও ভারতের রাজনীতিতে সেই পুরাতন রীতির প্রত্যাবর্তন ঘটে। সাম্প্রদায়িকতার রীতি আবার চালু হয়েছে ভারতের রাজনীতিতে। যার ফলে ভারতে একের পর এক দাঙ্গা-হাঙ্গামার কথা গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। ঠিক তেমনি এক ঘটনা হলো হিজাব বিতর্ক। যেখানে দেখা যায় কর্ণাটকের একটা কলেজে একজন মুসলমান নারী হিজাব পরে আসার কারণে তারই কলেজের শিক্ষার্থী তাকে কলেজে ঢুকতে বাধা দেয়। এবং রাম রাম বলে ধ্বনি দিতে থাকে। যার ফলে ওই নারী আল্লাহু আকবার বলে ধ্বনি দিয়ে নিজের ধর্মের কথা জানান দেয়। কেন এই ঘটনা ঘটল? যেখানে ভারতকে বলা হয় বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ। যেখানে বসবাসকারী প্রত্যেক নাগরিকের নিজের মতন করে বসবাস করার অধিকার রয়েছে। আবার একজন নারী কোন পোশাক পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সেটা তার নিজের ব্যক্তিস্বাধীনতা। তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্য কারও নেই। কলেজের নির্দিষ্ট পোশাক (ইউনিফর্ম) থাকলে সেই ক্ষেত্রে সেই রঙের হিজাব পরার অধিকার রয়েছে। কিন্তু ভারতে হিজাব পরিধান করা নিষিদ্ধ হচ্ছে। কেন, কারণটা হলো হিজাব মুসলমানদের পোশাক। কিন্তু সভ্য সমাজে এমনটা হওয়া কি উচিত? ভালোভাবে লক্ষ করলে আসল কারণ উদঘাটন করা সম্ভব। ভারতের যে রাজ্যে এ ঘটনা ঘটেছে, তার পার্শ্ববর্তী পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন। ফলে ক্ষমতাসীন দল এই বিতর্ক সৃষ্টি করে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার কৌশল করছে। আরও খোলাখুলি বলতে গেলে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করছে, তারা হিন্দু ধর্মকে কতটা ভালোবাসে। কিন্তু আমরা কী দেখেছি মুসলমানরা সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে। যদি তাই হয়, তাহলে পৃথিবীর কোনো দেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থান থাকতো না। এই যদি হয় আসল কারণ, তাহলে রাজনীতির কারণে সাম্প্রদায়িকতার কালো অধ্যায় রচনা ভালো কাজ হতে পারে না। কারণ পৃথিবীতে এখনো মানবাধিকার রয়েছে, যদি সেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় তাহলে মানুষ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে ঘৃণা হওয়া উচিত। মানুষ মানুষের জন্য তাহলে এখানে ধর্ম কেন বাধা হয়ে দাঁড়াবে তার সঠিক কোনো কারণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা মানুষ। মানুষ হিসেবে যেসব অধিকার রয়েছে সেটা অবশ্যই ভোগ করার অধিকার রয়েছে। যদি সেই অধিকার বঞ্চিত করা হয় তাহলে পৃথিবী থেকে মানবাধিকার শব্দটি উঠিয়ে দিতে হবে। এখন দেখার বিষয় জাতিসংঘ এই বিষয়ে কোন ধরনের ভূমিকা পালন করে। কারণ জাতিসংঘের একটা অংশের নাম মানবাধিকার সংগঠন, যার কাজ বিশ্বে মানব অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এখন দেখা যাক জাতিসংঘ তার কাজ কতটা সফলভাবে করতে পারে ভারতের এই বিতর্কের ক্ষেত্রে।
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়