আন্দোলন করায় অনেক নারীকে জেল খাটতে হয়েছে

কাজী সালমা সুলতানা: বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে পূর্ববাংলার নারীরাও ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে ভাষা আন্দোলনের সব ধরনের মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা রাতে লুকিয়ে ভাষার দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান-সংবলিত পোস্টার আঁকে। সে কারণে অনেক নারীকে জেল খাটতেও হয়েছে। তাদের কেউ হারিয়েছেন সংসার, কেউবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। সেসব ঘটনা নিয়ে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ, ভাষাসৈনিকদের স্মৃতিচারণা এবং দলিল ও বইতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘১১ মার্চ ভোর বেলা থেকে শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন ভবন ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। সকাল ৮টায় পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করলে কয়েকজন ছাত্রী বাধা দিতে গিয়ে পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হন। ঠিক ওই মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার অধিবেশন চলছিল। আনোয়ারা খাতুন ও অনেক মুসলিম লীগ সদস্য মুসলিম লীগ পার্টির বিরুদ্ধে আইনসভার প্রবল প্রতিবাদ করে।’ আত্মজীবনীতে তিনি আরও বলেন, “যে পাঁচ দিন আমরা জেলে ছিলাম, সকাল ১০টায় স্কুলের মেয়েরা (মুসলিম গার্লস স্কুল) ছাদে উঠে সেøাগান দিতে শুরু করত আর ৪টায় শেষ করত। ছোট ছোট মেয়েরা একটুও ক্লান্ত হতো না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই’, ‘ পুলিশি জুলুম চলবে না’এমন নানা ধরনের সেøাগান দিতে থাকত। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারীদের অনবদ্য ভূমিকা ছিল।”

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সাফিয়া খাতুন, সুফিয়া আহমেদ, রওশন আরা বাচ্চু ও শামসুন্নাহার আহসানের নেতৃত্বে কয়েকটি  সুসংগঠিত নারীদের দল রাস্তায় নামে। প্রথম দলটির নেতৃত্ব দেন সাফিয়া খাতুন। এসব দলে ছিলেন সারা তৈফুর, সোফিয়া করিম, সুফিয়া আহমেদ, হালিমা খাতুন, চমেন আরা, মনোয়ারা ইসলাম, আমেনা আহমেদ, জুলেখা নুরী, সুরাইয়া প্রমুখ। ছাত্রদের দল বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ তাদের ধরে ট্রাকে তুলছিল; ফলে তারা সেদিন ব্যারিকেড ভাঙতে পারেনি। ব্যারিকেড ভাঙার কাজ করে ছাত্রীরা। পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেলে অনেক ছাত্রী আহতও হয়। তাদের মধ্যে রওশন আরা বাচ্চু ছাড়াও সুফিয়া ইব্রাহিম, সারা  তৈফুরসহ ৮ জন মেয়ে ছিল। অনেক মেয়েকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের ভ্যানে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় পুলিশ নির্বিচারে ছাত্রদের ওপর গুলি করলে অনেকে নিহত ও আহত হয়। নিহত অনেকের মৃতদেহ পুলিশ নিয়ে যায়। পুলিশের এই বর্বরতার খবর সারাদেশে  ছড়িয়ে পড়ে।

পরদিন  থেকে ঢাকাসহ সারাদেশে  বিক্ষোভ  প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে। ঢাকার অভয় দাস লেনে অনুষ্ঠিত এক সভায় বেগম সুফিয়া কামাল, নূরজাহান মুরশদি, দৌলতুন্নসো খাতুন প্রমুখের নেতৃত্বে অসংখ্য নারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং নিন্দা প্রস্তাব আনেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি বেগম নূরজাহান মুরশদি ও লায়লা সামাদের নেতৃত্বে আহূত সভায় মিছিলে গুলি চালানোর প্রতিবাদে নিন্দা প্রস্তাব আনা হয়। নারায়ণগঞ্জরে হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে স্থানীয় পর্যায়ে সংগঠিত করেন। ২৯ ফেব্রুয়ারি তাকে গ্রেপ্তার করে কোর্টে আনা হলে সর্বস্তরের জনগণ কোর্ট প্রাঙ্গণে সমবেত হয় এবং বিনাশর্তে তার মুক্তি দাবি করে। কারবন্দি অবস্থায় বন্ড দিয়ে কারাগার থেকে মুক্তি লাভে অস্বীকৃতি জানান মমতাজ বেগম, সেজন্য তার স্বামী তাকে তালাক দেন। ১৯৫৩ সালে দেড় বছর কারাভোগের পর মুক্তি পান মমতাজ। ২০১২ সালে তিনি মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০