চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে বিমা খাতকে নতুন ভূমিকায় দেখতে চাই

আবুল কাসেম হায়দার: সাধারণ বিমা ও জীবন বিমা দেশের বড় খাত। ব্যাংক, পুঁজিবাজার, আর্থিক খাতের মতো বড় খাত হচ্ছে দেশের বিমা খাত। কিন্তু গত ৫০ বছরে এই খাত বেশ পিছিয়ে আছে। দেশের বিমা খাতের যেন অভিভাবক নেই। এই খাতের উদ্যোক্তাদের যেন টাকা উপার্জনের মেশিন বানিয়ে দিয়েছে। দেখভাল করার কোনো কর্তৃপক্ষ নেই বললেই চলে। অথচ হাজার হাজার কোটি টাকা ‘লুটপাট’ হচ্ছে। নীতিনির্ধারকদের চরম অবহেলা ও নীতি প্রণয়নে দক্ষতার অভাবে বিমা খাত চরমভাবে অবহেলিত। অথচ একটি প্রয়োজনীয় ও সম্ভাবনাময় বিমা খাত।

আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রাইস ওয়াটার হাইসকুপারসের (পিডব্লিউসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিসি) বিমা খাতের অবদান ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৪৯ শতাংশ। আর বিমা প্রিমিয়ামে মাথাপিছু ব্যয় বছরে ৯ মার্কিন ডলার অর্থাৎ ৭৭৪ টাকা, যা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম। দেশে সাধারণ বিমা ও সাধারণ জীবন বিমাসহ ৮৩টি বিমা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, থাকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের মতো বিমা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন সরকার দিয়েছে।

১৯৭১ সালের আগে দেশে এত বেশি বিমা কোম্পানি ছিল না। এমনকি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত প্রায় একমাত্র বাংলাদেশ সাধারণ বিমা ও বাংলাদেশ জীবন বিমা খাত দেশের মানুষের সেবা দিয়ে এসেছে। বর্তমানে দেশে ৪৭টি সাধারণ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি রয়েছে, জীবন বিমা রয়েছে ৩৬টি।

বিমা খাতের উন্নয়নের জন্য সরকার ২০১১ সালের বীমা অধিদপ্তর বিলুপ্ত করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) গঠন করে। এ যুগের অধিক হলো বিমা খাতের কোনো উন্নতি নেই। বরং অনেক পিছিয়েছে।

বিমা খাত নিয়ে আমাদের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘আসলে খাতটি যাদের হাতে পড়ার কথা ছিল, তাদের হাতে পড়েনি। ফলে এটি অর্থনীতির অন্য খাতগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারছে না। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের এ খাতের খারাপ অবস্থার কথা অস্বীকার করার জো নেই।’

কত বড় বিমা খাত: শুধু ২০২০ সালে বেসরকারি জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর আয়ের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২১ সালে জীবন বিমা তহবিলের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা।

আইডিআরএর ওয়েবসাইটে সন্নিবেশিত তথ্যমতে, ২০১৭ সালে বিমা খাতে জীবন বিমা পলিসি সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৯ লাখ। আর সাধারণ বিমা ২৪ লাখের বেশি।

একই বছর নন-লাইফ বিমা খাতে মোট প্রিমিয়াম আয়ের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। সম্পদ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকায়। বিনিয়োগ ছিল সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বেশি।

বিমা খাতে ৩ লাখ ৮৪ হাজারের বেশি প্রতিনিধি বা এজেন্ট কাজ করছে। বিমা কোম্পানিতে কাজ করছে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয় : অর্থ মন্ত্রণালয়ের খাতগুলো হচ্ছে ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও শেয়ার বাজার। সারা বিশ্বে এসব খাতই সব সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের পর থেকে বিমা খাত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিমা খাতকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে নিয়ে আসে। দুইটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই খাতকে উন্নয়ন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে বিমা আইন ২০১০ এবং ‘বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১০’ প্রণয়ন করে। আইনের অধীনে ২০১১ সালে আইডিআরএ গঠন করা হয়। ২০১১ সালে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যুক্তরাষ্ট্র থেকে এনে এম শেফাক আহমদকে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের দায়িত্ব প্রদান করেন।

বিমা খাতের জনবল উন্নয়নে: ২০১১ সালে সরকার শেফাক আহমদকে তিন বছরের জন্য চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয় এবং চারজন সদস্য ও ওই প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় অন্য কোনো জনশক্তি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। অবশ্য শেফাক আহমদ অস্থায়ীভাবে ২০১১-২০১২ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০ জন ডিগ্রিধারী ব্যক্তিকে অস্থায়ীভাবে আইডিআরএ নিয়োগ প্রদান করেন। এসব অফিসারদের দিয়ে শেফাক আহমদ তদন্ত ও পরিদর্শন দল গঠন করে কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করেন। বিমা কোম্পানিগুলোর অনিয়ম, অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু একটি কোম্পানি শেফাক আহমদের বিরুদ্ধে জেলায় জেলায় হয়রানিমূলক মামলাও করেছিল।

দ্বিতীয় দফায়ও শেফাক আহমদ নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাই তিনি কিছু সংস্কারমূলক কাজ করার চেষ্টা করেন। তার পরে আইডিআরএর চেয়ারম্যান হয় সাবেক সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারী। এরপর চেয়ারম্যান হয় এম মোশাররফ হোসেন। মোশারফ হোসেন আসার পর বিমা খাতের এই প্রতিষ্ঠানের তৎপরতা একেবারে কমে যায়।

বর্তমান চেয়ারম্যানের মতে এই সংস্থার জনবল প্রয়োজন কমপক্ষে ৩০০ জনের। কিন্তু সরকার এখনও তা দিতে পারেনি। তাই দপ্তরের কাজের তৎপরতা নেই। অনিয়ম, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার শক্তি আরআরডিআরএর এখন নেই বললেই চলে।

জনবল কাঠামো: বাংলাদেশে বর্তমানে ৬০টি ব্যাংক রয়েছে। এগুলোর নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছে সাত হাজারের অধিক। অন্যদিকে আর একটি প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। তাদের জনবল রয়েছে ২৫০ জনের মতো। আর আইডিআরএর জনবল হচ্ছে মাত্র ৮০ জনের মতো। হিসাবে দেখা যাচ্ছে, একটি বিমা কোম্পানির বিপরীতে একজনের চেয়ে কম জনশক্তি রয়েছে। অন্যদিকে বেশির ভাগ ব্যক্তির চাকরি অস্থায়ী।

২০১২ সালে আইডিআরএ ১৯৫ জন জনবল কাঠামোর একটি প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। মন্ত্রণালয় মাত্র ৯৫ জনের অনুমোদন দেয়। পরবর্তী ২০১৪ সালে আবারও ১৯৫ জন জনবলের অনুমোদন চাইলে মন্ত্রণালয় ১৫৫ জনের অনুমোদন দেয়।

আইডিআরএর জনবল কাঠামো চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় ২০১৬ সালে। এরই মধ্যে পাঁচ বছর চলে গিয়েছে। জনবল নিয়োগ হয়নি। ব্যাংক, পুঁজিবাজার, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ‘টেকনিকেল’ বেশি হলেও বিমা খাতের প্রতি নজর কেন নেই? বিশ্বের দেশে দেশে বিমা খাতই দেশের মানুষের একমাত্র রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে আসছে।

সদস্য পদ নিয়ে যত সমস্যা: আইডিআরএর চারটি সদস্য পদ রয়েছে। বর্তমানে দুই সদস্য পদ খালি য়েছে। নন-লাইফ সদস্য পদটি দীর্ঘ চার বছর ধরে খালি পড়ে রয়েছে। তবে কাজ কীভাবে হবে। বিমা খাতের এই বৃহৎ অংশের দেখাশোনা কীভাবে হচ্ছে। হচ্ছে না। অস্থায়ী সদস্য বা কর্মকর্তা দিয়ে এই প্রতিষ্ঠান কোনোভাবে ভালো চলতে পারে না। বিশাল এই সম্ভাবনাময় খাত আজ উপেক্ষিত। কিছু সংখ্যক অসাধু উদ্যোক্তা অনেক প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে নিজেরা ভোগ বিলাসে ব্যয় করার সুযোগ করে নিয়েছে। যেহেতু তদারকি করার শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানটি বড়ই দুর্বল।

সংগঠনে এক ব্যক্তি অবিরাম: বিমা কোম্পানিগুলোর একটি সংগঠন আছে। নাম বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ)। এই সংগঠনের সভাপতি পদ ১১ বছর ধরে রয়েছেন শেখ কবির হোসেন। বেশ ভালো আছেন। অন্যান্য সংগঠনে পর পর দুইবার দায়িত্ব পালনের পর একবার অবসর নিতে হয়। কিন্তু এই সমিতিতে সেই বিধান বাদ দেয়া হয়েছে, যেমনি ব্যাংকের মালিক সমিতির দশাও তা-ই। দীর্ঘদিন ধরে নজরুল ইসলাম মজুমদার সভাপতি। কীভাবে? উপকার কি ব্যাংকের মালিকেরা ও বিমার মালিকেরা বেশি পাচ্ছেন!

বিমামালিকদের পোয়াবারো: একসময় সাধারণ বিমার প্রিমিয়ামের ওপর গ্রাহকরা ৫০ শতাংশ কমিশন ফেরত দিতেন। সমিতি ও বিমা মালিকরা অতি চতুরতার সঙ্গে সুচারুভাবে সরকার দিয়ে গ্রাহকদের কমিশন বাবদ ফেরত দেয়ার বিধান সম্পূর্ণরূপে তুলে নিতে সক্ষম হয়েছে। এখন বিমা কোম্পানিগুলো পুরো প্রিমিয়ামই তাদের আয় হিসেবে নিতে পারছে। বিমা খাতের গ্রাহকদের দেখার কেউ নেই। ব্যাংকিং খাতে, পুঁজিবাজারে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো কিছুটা হলেও গ্রাহকদের কল্যাণে কিছু কাজ করে। কিন্তু বিমা খাত একেবারে অরক্ষিত। একমাত্র বিমার মালিকদের একচ্ছত্র মালিকানার দাপটে গ্রাহকরা দিশেহারা। অন্যদিকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে বিমা খাতের প্রিমিয়ামও আমাদের দেশে অনেক বেশি। বিষয়টি সরকারকে তলিয়ে দেখা খুবই জরুরি।

নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন: বিমা খাতের মূল সমস্যা আস্থা। মানুষের আস্থা এখনও বিমা খাত অর্জন করতে পারেনি। সাধারণ বিমা ব্যবসায়ীদের বাধ্য হয়ে করতে হয়। না হলে ব্যবসা করা যাবে না। কিন্তু উপকার কতটুকু পাচ্ছেন তা গ্রাহক মাত্রই ভালো জানেন। জীবন বিমা ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, আস্থা এখনও অর্জন করতে পারেনি।

অথচ আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু প্রতিবেশী ভারতে বিমা খাত খুবই জনপ্রিয়। লাইফ ইন্স্যুরেন্স অব ইন্ডিয়ার (এলআইসি) সম্পদ এত বেশি যে তা দিয়ে বাংলাদেশের আটটি বাজেট করা যাবে। বিমা খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে পারলে বিমার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে। মানুষের জীবন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ঝুঁকি অনেক হ্রাস পাবে। এজন্য প্রয়োজন শক্তিশালী, স্বচ্ছ, দক্ষ জনবল সমেত নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।

কেউ কেউ মনে করেন শেয়ারবাজার একটি জটিল ব্যবসা, কেউ কেউ মনে করেন ব্যাংক খাত বড়ই সমস্যা ও জটিল। কিন্তু এর চেয়ে বিমা খাত সবচেয়ে বেশি জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এই খাতের জন্য প্রয়োজন দক্ষ, অভিজ্ঞ, সৎ, নিষ্ঠাবান একটি জনবল, যার ঘাটতি আইডিআরএ রয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আমাদের দ্বারে উপস্থিত এবং বিপ্লবে জয় লাভের জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী বিমা খাত। বিশ্বব্যাপী বিমা খাতই নাগরিকদের স্বাস্থ্যের মূল সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু আমাদের দেশে তা নেই। পরিবর্তন সর্বক্ষেত্রে আনতে হবে।

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, আইএফআইএল, অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও আবুল কাসেম হায়দার মহিলা কলেজ, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম

ই-মেইল:aqhaider@youthgroupbd.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০