জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত

কাজী সালমা সুলতানা: ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে শুরু হয়ে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ৮ বছর ব্যাপী ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয়। বাঙালি জাতির প্রথম বিদ্রোহ ছিল ভাষা আন্দোলন। তারই ধারাবাহিক আন্দোলনের পথে স্বাধীনতার পথে এগিয়েছে বাঙালি জাতি।

প্রায় দুই হাজার বছরের লিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাঙালি কখনও স্বাধীন আবার কখনও বিদেশি শাসকদের শোষণের শিকার হয়েছে। বিদেশি শাসক দ্বারা শাসিত হলেও বরাবরই বাঙালি লড়াই করেছে স্বাধীনতার জন্য। তার প্রতিফলন দেখতে পাই সেই কৈবর্তের বিদ্রোহ থেকে।

১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যাওয়ার কথা বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাঙালি শাসক ছিলেন না। তবে সিরাজের পতনের ভেতর দিয়ে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয়। এরপর প্রায় ২০০ বছর বাংলাসহ গোটা ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের শোষণে নিষ্পেষিত হতে থাকে। এই ২০০ বছরে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন বাঙালিরা।

১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের মাধ্যমে সবচেয়ে সংঘটিত সংগ্রাম শুরু হয়। সেই সংগ্রামে পরাজয় ঘটলেও বাঙালিদের মধ্যে এক বিপ্লবী চেতনার জন্ম দেয়। এই সিপাহি বিদ্রোহ কোম্পানি শাসনের পরিবর্তে ভারতবর্ষে ব্রিটেনের রানির শাসন কায়েম হয়। পরাক্রমশালী ব্রিটিশ শাসন কায়েম হলেও স্বাধীনতার সংগ্রাম থেমে থাকেনি। মাস্টার দ্য সূর্যসেন, বীরকন্যা প্রীতিলতা, ক্ষুদিরাম, বিনয়, বাদল,  দীনেশসহ অসংখ্য বাঙালি অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন স্বাধীনতার জন্য। সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে যায় কিন্তু বাংলাকে বিভক্ত করে হয় দ্বিজাতি তত্ত্বের আসার দর্শনের ওপর দাঁড়িয়ে। ফলে স্বাধীনতার নামে পূর্ববাংলা পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়।

প্রকৃতপক্ষে ভারত ভাগের পরই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। এ সময় সম্পদ বণ্টনেই সে চিত্র ফুটে ওঠে। আর ভাষার প্রশ্নে দেখা দেয় প্রথম অসন্তোষ। সেই অসন্তোষ দানা বেঁধে ওঠে আন্দোলন আর সংগ্রামের পথে। রক্ত ঝড়ে রাজপথে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায়, যা ইতিহাসে বিরল। এরপর প্রতিটি ক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বৈষম্যমূলক আচরণ বাঙালিকে ঠেলে দিয়েছে রাজপথে। বাঙালির দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৭১ সালে। এর আগে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সুযোগ পায় বাঙালি। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর বাঙালির কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয় যে, এক রাষ্ট্রের আবরণে বাঙালি মূলত ঔপনিবেশিক শাসনের নিগঢ়েই বন্দি রয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কখনোই বাঙালিকে সমমর্যাদা বা সম্মানের দৃষ্টিতে দেখেনি। তারই প্রতিফলন ঘটে নির্বাচনের ফলাফলকেও উপেক্ষা করার পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে আকস্মিভাবে ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের একটি প্রধান দল পিপলস পার্টি এবং অন্য কয়েকটি দল ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

তার এ ভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতারা দলে দলে বটতলায় জড়ো হতে শুরু করেন। বেলা ৩টায় পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভা হয়। এদিন ঢাকায় ছাত্রসহ সব শ্রেণির মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদিন বিকালে হোটেল পূর্বাণীতে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি পরদিন ২ মার্চ ঢাকা শহরে হরতাল ও ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল ও ৭ মার্চ রেসকোর্সে জনসভা অনুষ্ঠানের ঘোষনা দেন।

জয় বাংলা বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন করো; তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা; জাগো জাগো বাঙালি জাগো প্রভৃতি স্বাধীনতার স্লোগানে ঢাকা নগরী আন্দোলিত হয়। সেদিনই বাঙালির হƒদয়ে জন্ম নেয় বাংলাদেশ।  

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০