নিজস্ব প্রতিবেদক: দশ বছরে প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছে ঋণ অবলোপনের পরিমাণ। ব্যালান্সশিট পরিষ্কার রাখতে রাষ্ট্রায়ত্তসহ বেসরকারি ব্যাংকগুলো এ সুবিধা নিয়েছে। একটি গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে পুরো ব্যাংকিং খাতের ঋণ অবলোপনের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর অঙ্ক গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৩০০ কোটিতে।
দশ বছর আগে সরকারি ব্যাংকের ঋণ অবলোপনের পরিমাণ ছিল সাত হাজার কোটি টাকা। দশ বছর পর তা এসে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৯৪০ কোটি টাকায়। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ অবলোপন ছিল ৬ হাজার ৯৬০ কোটি। এখন তার পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৯৪০ কোটিতে।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, দশ বছরের ব্যবধানে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। কারণ ২০১১ সালে ৬ শতাংশ থাকলেও ২০১৯ সালে খেলাপির হার পৌঁছায় ১২ শতাংশে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ বলেন, খেলাপি নামের এ ক্যানসার ব্যাংকিং খাতের জন্য মোটেও ভালো নয়। ব্যাংকের সব সমস্যার মূল এই খেলাপি ঋণ। যেকোনো মূল্যে এটা কমিয়ে আনতে হবে।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। তবে খেলাপির নানা শ্রেণিভেদে ২০ থেকে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আওতায় ২০০৩ সাল থেকে ব্যাংকগুলো ঋণ অবলোপন করে আসছে। যদিও প্রথমে পাঁচ বছরের বেশি ঋণ অবলোপন করা যেত, এখন তা তিন বছর হলেই অবলোপন করা যায়। সাধারণত খেলাপি হওয়ার পর যে ঋণ আদায় করার সম্ভাবনা খুবই কম, সেই ঋণ অবলোপন করে ব্যাংকগুলো। তবে এ ঋণ পুনঃতফশিল বা পুনর্গঠন করা যায় না।
সাম্প্রতিক সময়ে খেলাপি ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রে নীতিমালায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আগে মামলা ছাড়া ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অবলোপন করা যেত। আর এখন ২ লাখ টাকা পর্যন্ত মামলা ছাড়াই অবলোপন করা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন শিথিল নীতিমালার কারণে খেলাপি ঋণ অবলোপন বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো।
গত কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। ২০১৯ সালে বিশেষ নীতিমালার আওতায় ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয় সরকার। যদিও কভিড-১৯-এর কারণে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি বিবেচনায় কয়েক দফায় সুযোগ দেয়া হয়, যা গত ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। তাই এ ধরনের ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ থাকায় ব্যাংকগুলো আর্থিক প্রতিবেদন পরিচ্ছন্ন দেখাতে কৌশলেই মন্দমানের খেলাপি ঋণ অবলোপন করার পথে হাঁটছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) অডিটোরিয়ামে ‘ব্যাংকিংয়ে নৈতিকতা’ শীর্ষক ২০তম নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতায় পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ জানান, গ্রাহকদের ঢালাও বিভিন্ন নীতি সুবিধার কারণে খেলাপি ঋণের লাগাম টানা যাচ্ছে না। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন শিথিলতা আনার কারণে ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংখ্যা বাড়ছে। খেলাপি ঋণের মতো জাতীয় সমস্যার সমাধানে বারবার সুবিধা দেয়া টেকসই কোনো বিকল্প নেই। খেলাপি নামের এই ক্যানসার ব্যাংকিং খাতের জন্য মোটেও ভালো নয়।