পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকরা কতটা সুখী?

প্রতিদিন সকাল ৬-৭টা শহর জীবনের কর্মব্যস্ততা শুরু না হলেও তৈরি পোশাক কারখানার কর্মীদের পদচারণায় মুখর শহর-নগরের অলিগলি। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ অনেক জেলায় প্রতিদিন সকালের এটাই সাধারণ দৃশ্য। জীবন-জীবিকার তাগিদে একটু ভালো থাকার আশায় অনেকেই গার্মেন্টসে কাজ করছেন। আমাদের দেশের গার্মেন্টস শ্রমিকের বড় একটা অংশ নারী। পারিবারিক অসচ্ছলতা, উপার্জনক্ষম সদস্যের অভাব কিংবা ছোট ভাই-বোনদের পড়াশোনা ইত্যাদি কারণে নারীরা গার্মেন্টসে কাজ করতে বাধ্য হন। অবিবাহিত নারীরা যেমন পরিবারকে সাহায্য করার জন্য গার্মেন্টসে কাজ করছেন, তেমনি অনেক বিবাহিত নারীরাও স্বামীকে আর্থিক সহায়তা করা কিংবা স্বামী-সংসার নিয়ে আরেকটু সুখে থাকার জন্য গার্মেন্টসে কাজ করছেন। বাসাবাড়িতে কাজের ফলে যে নিগ্রহের স্বীকার হতে হয় তা থেকে মুক্তি, ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা কিংবা সেলাই কাজের স্বল্প জ্ঞান থাকলেও চাকরির সুযোগের কারণে স্বল্পশিক্ষিত নারীদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করছে গার্মেন্টস। অনেকের মতে, গার্মেন্টসে মোট শ্রমিকের ৮০ শতাংশই নারী। বিবিএসের তথ্য মতে, (২০১৬) মোট গার্মেন্টস কর্মীদের প্রায় ৫৪ শতাংশ নারী অর্থাৎ ৪০ লাখের মধ্যে কমবেশি ২২ লাখ কর্মী নারী। এই তথ্যটির গুরুত্ব বেড়ে যায় যখন দেখা যায় ২০১৬/১৭-এর শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য মতে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে নিয়োজিত মোট নারী কর্মীর সংখ্যা ৩১ লাখ ৪৫ হাজার। অর্থাৎ গার্মেন্টস সেক্টরে নিয়োজিত নারী কর্মী দেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে নিয়োজিত মোট নারী কর্মীর ৭০ শতাংশ।

মাস শেষে পাওয়া বেতনের টাকা দিয়ে পরিবারের  নৈমিত্তিক চাহিদা যেমন মেটানো হয়, তেমনি প্রাণান্তকর চেষ্টা করা হয় জীবনযাত্রার মানকে আরেকটু উন্নত করার। তাই সারা মাস সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কঠোর খাটুনি খাটা হয় এবং বেশিরভাগ সময়ই তা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা নির্ধারিত দৈনিক শ্রমঘণ্টা ৮ ঘণ্টাকে ছাড়িয়ে ১০-১২ ঘণ্টা হয়ে যায়। যদিও  বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬-এর ১১৩ ধারা নোটিস ও রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কর্মঘণ্টার মিল থাকার কথা বলা হয়েছে। আবার এর বাইরে আছে ওভারটাইম। আই এলও স্ট্যান্ডার্ডের তাল রেখে বাংলাদেশের শ্রম আইন-২০০৬-এর ৯৪ (১) ধারায় বলা হয়েছে, সাধারণত চল্লিশ বা ততোধিক মহিলা শ্রমিক নিয়োজিত আছেন এরূপ প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে তাদের ছয় বছরের কম বয়সী শিশু সন্তানগণের ব্যবহারের জন্য এক বা একাধিক উপযুক্ত কক্ষের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ করিতে হইবে। কতিপয় প্রতিষ্ঠান ব্যতীত এই বিধান কেউ মানে না বললেই হয়।

শ্রম আইন-২০০৬ এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা অনুসারে, ওভারটাইম মজুরি ঘণ্টা প্রতি দ্বিগুণ হওয়ার কথা বললেও বেশিরভাগ সময়ই তা লঙ্ঘিত হয়। আবার অনেক সময় কাগজে-কলমে বেতন স্কেল ও প্রকৃত বেতন সমান হয় না। অনেক সময় সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও যেতে হয় কর্মস্থলে। শ্রম আইন-২০০৬  এ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ধোঁয়া, ধুলা-বালি, বর্জ্য পদার্থ অপসারণসহ স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও তা খুব কমই মেনে চলা হয়। শারীরিক ও মানসিক হয়রানির স্বীকার গার্মেন্টস কর্মীর সংখ্যাও কম নয়। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে,  অনেক নারী কর্মীই কোনো না কোনোভাবে হয়রানির স্বীকার হন সহকর্মী পুরুষ দ্বারা, না হয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দ্বারা। আবার অনেক নারী কর্মীই  তাদের কুপ্রস্তাব দেয়া কিংবা তুচ্ছ কারণে অকথ্য ভাষায় গালি দেয়া হয় বলে জানান।

পোশাকশিল্প বাংলাদেশের  সম্ভাবনাময়। এ শিল্প রপ্তানি করে প্রতি বছর দেশ অর্জন করছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। এই শিল্প এ দেশের অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া নারী জাতিকে দিয়েছে মুক্তির সাধ, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য। তাই দেশের এই সম্ভাবনাময় শিল্পকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই শিল্পের সংস্কার সাধন দরকার। কাজের নিরাপদ পরিবেশ, বেতন-ভাতা অন্যান্য সুবিধা যেমন বাড়ানো উচিত, তেমনি শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা বিশেষত নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আরও মনোযোগী হওয়া উচিত। নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। যাতে করে তারাও দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হয়ে পুরুষদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সর্বোপরি এই শিল্পকে চাঙ্গা করতে, দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধি করতে, সার্থক করতে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

সুহাইফা জহির শৈলী

শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০