নারীদের সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত

স্মিতা জান্নাত: দেবীরূপী নারী, যারা ঘরের পাশাপাশি আজ বাইরের দুনিয়াতেও সমানভাবে নিজ পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষক, ডাক্তার, চাকরিজীবী, পুলিশ, পাইলট, প্রকৌশলী, উকিল, ব্যবসায়ী, সশ্রস্ত্র বাহিনী, রাজনৈতিক অঙ্গনেও নারীদের পদচারণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

সকাল ৯টা থেকে ৫টার অফিস কর্মের সঙ্গেও নারীরা ঘর সামলে যাচ্ছেন দৃঢ়তার সহিত। নারী মানেই লক্ষ্মী আবার সেই নারীই সরস্বতী। কিন্তু আজ সেই নারীই নিরাপত্তাহীনতার শিকার। লোকাল বাস থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে, রাস্তায়ও তারা নানা রকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। যেটা অনেকেই চেপে যাচ্ছেন সম্মানের কথা ভেবে আর বাকিরা স্বাধীনতা হারানোর ভয়ে যার সুযোগ দিচ্ছেন আমাদের আশপাশে মানুষের সঙ্গে মিশে থাকা মানুষরূপী নরপিশাচকে। তাদের অনেকেই নারীকে শুধু অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে মজা পায় কিন্তু এটা ভেবে দেখে না তাদের এই ঘৃণ্য কৃতকর্মের জন্য নারীরা কতটা ভুগছেন।

দেশে মোট নারীর মধ্যে ৬৫.৫৮ শতাংশই যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ৪৫.২৭ শতাংশ তরুণী গণপরিবহনে যৌন হয়?রানির শিকার হচ্ছেন। গণপরিবহন ও বাসস্ট্যান্ডে যৌন হয়রানির মতো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন ৮৪ দশমিক ১০ শতাংশ তরুণী। পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২ দশমিক ২৬ শতাংশ তরুণী।

শুধু কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নয়, নিজের ঘরে বসে অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৭৯ শতাংশের বেশি কখনও না কখনও অনলাইনে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে নারী প্রায় ৫৩ শতাংশ। এই নারীদের বেশিরভাগ আপত্তিকর ও অপমানজনক মন্তব্যের শিকার হন।

শুধু তাই নয়, এমনকি নিজের পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজনের কাছেও নানাভাবে হয়রানি হতে হয় নারীকে। যাদের কাছে নারীরা নিজেদের বেশি সুরক্ষিত মনে করে তারাও বিভিন্নভাবে কুপ্রস্তাব দিতে পিছপা হয় না। নারীরা নিজ বাড়ি?তেই সুরক্ষিত নয়। আর শুধু নারী কেন, শিশু-কিশোরীরা বেশি এমন পরিস্থিতির স্বীকার হয়, যার অনেকটাই তারা সারাজীবন মনে বয়ে বেড়ায় একটি আতঙ্ক হিসেবে।

আর দুঃখজনক হলেও সত্যি, নারীরা এমন পরিস্থিতির স্বীকার হলেও পরিবারের থেকে যাথাযথ সাহায্য বা সহযোগিতা পান না তারা। পরিবারের সদস্যরা ঘুরেফিরে নারীদের ত্রুটি ধরেই তাদের মনোবল ভেঙে দেন। যার ফলে সেই নারী বারবার এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেও পরিবারকে জানাতে দ্বিধাবোধ করে এবং চুপচাপ সহ্য করতে করতে একসময়? নিজেকে নিয়েই হতাশায় পড়ে যায় এবং নিজেকে গুটিয়ে ফেলে সমাজের থেকে। নিজেকে বা ভাগ্যকে দোষ দিতে দিতে একসময়? নিজেকেই না ফেরার দেশে নিয়ে যায় তারা। তবুও সমাজের কাছে তারাই অপরাধী, কারণ তারা নারী।

পরিবারের একটি কমন কথা‘কারও সঙ্গে এগুলো হয় না, তোমার সঙ্গেই কেন হয়!’ যা একটি নারীর মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আর তাছাড়া সমাজে একটি প্রচলিত নিয়ম চলে আসছে, অন্যায় নারী করুক বা না করুক লাঞ্ছিত আর কলঙ্কিত শুধু নারীরাই হবে। আর অন্যায় করা পুরুষটি নির্দ্বিধায় বুক ফুলিয়ে আরেকটি নারীর জীবন ধ্বংসের স্বপ্ন দেখবে। আর সমাজের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের কাছেও নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়। দিন দিন এভাবেই আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক মেধাবী ভবিষ্যৎ।

আবার অনেকে বলেন, ‘নারীদের বাইরে কাজ করতে যাওয় মানে শিয়ালের সামনে মুরগি ছেড়ে দেয়া।’ যে মানুষ অন্যায়কে এভাবে রসিকতার সঙ্গে প্রশ্রয় দেয়, সেসব মানুষের কাছে নারী জাতি মুরগি ব্যতীত আর কিছু না বলেই ধরে নেওয়?া যায়।

তাছাড়া সমাজে আরও একটি প্রচলিত ধারণা আছে, নারীরা সব কাজের যোগ্য নয় অথবা সব কাজ নারীদের জন্য নয়। সমাজের এ ধারণাকেই নানাভাবে নারীরা চ্যালেঞ্জ করে এসেছেন এবং এমন অনেক স্থানে পৌঁছেছে, যেখানে তাদের কেউ কল্পনাও করেনি। তবুও আমাদের সমাজের কাছে কেন জানি না নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অযোগ্য বা সঠিক যোগ্য নয় বলেই বিবেচিত হয়।

আমাদের সংস্কৃতিতে নারীরা দেবী, তাই তাদের সেই রূপে দেখতেই বেশি ভালো বাসেন সবাই। অবশ্যই লজ্জা নারীর ভূষণ এবং তারা সেটা মেনে চলতে সক্ষম। কিন্তু কোনো নারী যদি নিজ ইচ্ছাতে পশ্চিমা সংস্কৃতি অবলম্বনে সেই বেশভূষা ধারণ করে থাকে, তবে সমাজেরও কোনো অধিকার নেই তাকে অপমান বা তার প্রতি অসদাচরণ করা। পর্দা হোক বা পাশ্চাত্য পোশাক, নারীরা নিজ সমাজে সুরক্ষিত হতে হবে; কারণ নিজের পোশাকের অধিকার সম্পূর্ণ তার নিজের। পোশাকের বাহানা দিয়ে কোনো নারীর দিকে কুদৃষ্টি দেয়?া ন্যায্য দাবি করা মানুষগুলো আর যাই হোক প্রকৃত মনুষ্যত্বের অধিকারী হতে পারে না।

অবশ্যই নারী মা জাতি, তাই নিজের সম্মান রক্ষা করে চলা তার দায়িত্ব। কিন্তু তাই বলে মা বলে তাকে তার স্বপ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন করে চার দেয়ালে বা সংসারের গণ্ডিতে বেঁধে রাখা উচিত নয়। নারীরা শুধু সংসার করতে জন্মায়নি, তাদেরও সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সমান অধিকার রয়েছে। কিছু বিকৃত মানসিকতার মানুষের জন্য যেন কোনো নারীকে নিজ স্বপ্ন বিসর্জন দিতে না হয়। নারী যে পোশাকেই থাক, যে কর্মসংস্থানে থাক বা যে স্থানে থাক না কেন নিজ দেশে সুরক্ষিতভাবে চলাফেরার অধিকার তার আছে।

শিক্ষার্থী, ইংরেজি ভাষা বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০